“এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না; দিন ছিল না, রাত্রিও ছিল না; সৎ ছিল না, অসৎ ও ছিল না- তখন কেবলমাত্র ভগবান শিবই ছিলেন।”- শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ। শিব হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ দেবতা। তিনি আদি, তিনি অন্তবিহীন। বেদান্ত অনুসারে তিনি মহা ঈশ্বর। বিভিন্ন শাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন রূপে বিরাজমান মহাদেব। দক্ষিণবঙ্গের নিম্ন গাঙ্গেয় ও জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষের কাছে মহাদেব পূজিত হন মাকাল রূপে। ঐতিহাসিকদের মতে, মাকাল শব্দটি মহাকালের অপভ্রংশ। আবার কেউ মনে করেন ‘মহাকাল’ শব্দটির ধ্বনি লোপ পেয়ে ‘মাকাল’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।
মাকাল ঠাকুর সাধারনত মৎস্যজীবি ও জেলে সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা। হাওড়া জেলায় গ্রামাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা মাকাল ঠাকুরকে মাকালচণ্ডী নামে অভিহিত করেন। পুকুরে মাছ চাষ করতে যাওয়ার আগে মাকাল ঠাকুরের পুজো দেওয়ার রীতির প্রচলন অতি প্রাচীন। প্রচলিত পালাগানের শিবের চাষ পালায় মৎস্য শিকারী রূপে মহাদেব ও গৌরী দেবীকে দেখা যায়। একদিকে তারা ধানক্ষেতের জমা জলে মাছ ধরছেন, তেমনিই অপরদিকে সেই মাছ মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন। অনুমান করা যায়, এই কারণে মৎসজীবি সম্প্রদায় হরগৌরীকে জেলেদের দেব-দেবী রূপে কল্পনা করে পুজো করেন।
মাকাল ঠাকুরের কোনও মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট মূর্তি নেই। মূর্তি অতি সাধারণ, নির্মাণ পদ্ধতি অতি সহজ। মাটির একটি অথবা একসঙ্গে দুটি ছোট স্তূপের প্রতীকে পুজো করা হয়। পুকুরের খোল থেকে আঠালো পাঁকমাটি অল্প নিয়ে দুই হাতের তালুতে রগড়ে চার ছয় ইঞ্চি লম্বা ও দু তিন ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত করা হয়। তারপর তর্জনী বুড়ো আঙ্গুলের চাপ দিয়ে নাক, চোখ, মুখ তৈরি করে পূজার বেদীতে বসানো হয়। যেখানে জোড়া প্রতীকে পুজো করা হয় সেখানে দু’টি প্রতীকের মধ্যে স্ত্রী দেবতা-পুরুষ দেবতা ভেদভেদা করা হয় না। উপাসকেরা দুটি প্রতীককেই দেবতার মূর্তি মনে করেন।
খেটে খাওয়া মানুষের উপাস্য মাকাল ঠাকুর খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট। মাকাল ঠাকুরের পুজোর প্রধান উপকরণ হল বাতাসা। শালপাতা অথবা কাগজের ঠোঙায় সামান্য বাতাসা। কোথাও কোথাও তার সঙ্গে কিছু ফলমূল এবং চিনির সন্দেশ। কলাপাতায় মাকাল ঠাকুরের বেদীর সামনে অর্ঘ্য দেওয়া হয়। ধুপ, প্রদীপ জ্বেলে আরাধনা হয়। সন্ধ্যেবেলা মাকাল ঠাকুরের কাছে খড় জ্বালানো হয়। মাকাল ঠাকুরের পুজো করতে লাগে না কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিত। যে বা যারা মাছ ধরতে যায়, তারা নিজেরাই খড় জ্বালিয়ে এই পুজো করে থাকেন।
সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের মধ্যে মাকাল পদবি দেখা যায়। এছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় মাকাল নামযুক্ত একাধিক গ্রামও রয়েছে, যেমন মাকালপুর, মাকালতলা ইত্যাদি। আমাদের লৌকিক ইতিহাসের সঙ্গে মিশে রয়েছেন মাকাল ঠাকুর। মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম মূর্তিটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। কাদামাটি দিয়ে তৈরি মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম কাল্পনিক মূর্তি দেবদেবী সম্পর্কিত নিরাকার অবশেষ রূপে ধরা হয়। যা খ্রিস্টপূর্ব যুগের বলে অনুমান করা যায়।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – জিয়ো বাংলা
Discussion about this post