বাল্মীকির রামায়ণে রাম চরিত্রটি ছিলেন সম্পূর্ণ ভাবে রাজরসে পরিপূর্ণ, যিনি একজন ক্ষত্রিয়ের পরম উদাহরণ। যুগ যুগ ধরে ক্ষত্রিয়দের নিজের ধর্ম ও কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা দিতে রামায়ণ ব্যবহৃত হয়েছে পাঠ্য হিসেবে। কিন্তু এই রামায়ণ পৌরাণিক যুগের পর থেকে, অর্থাৎ আজ থেকে হাজার বছর আগে থেকে ধীরে ধীরে দেব ভাষা ছেড়ে যখন আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত হতে শুরু হল, তখন সেটি হয়ে উঠল ভক্তি রসে পরিপূর্ণ । কেউ কেউ এই পরিবর্তনের জন্য তৎকালীন ভারতের ভক্তিবাদী আন্দোলনকে দায়ী করে থাকেন। এই ভক্তিবাদই, ধীরে ধীরে বহু অঞ্চল ও ভাষা ঘুরে তুলসীদাসের উপাস্য রামকে সর্বজনীন করতে সাহায্য করেছিল, বাংলাও যাঁর মধ্যে অন্যতম। যদিও এই পরিবর্তন এক দিনে আসেনি।
আঞ্চলিক রামায়ণ ও ভারতীয় রামায়ণ সংস্কৃতিতে তাঁর প্রভাব
ঐতিহাসিকদের মতে, পুরাণ লেখা শুরু হয় প্রায় দুই হাজার বছর আগে। রামায়ণ ও মহাভারতের মূল গল্প তাঁর আগের। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষায় রামায়ণ লেখা বা অন্য ফরম্যাট আসে পৌরাণিক যুগের সমসাময়িক কাল বা তাঁর পরে। এখানে রামায়ণে আমরা দুটি শিফট দেখতে পাই। মূল ন্যারেটিভে প্রথম পরিবর্তনটি হল, রাজরসে পরিপূর্ণ রাম হয়ে গেলেন ভক্তিরসে পূর্ণ। দ্বিতীয়ত, যত ইসলামিক ও পশ্চিমা দর্শন আমাদের দেশে ঢুকতে শুরু করল, তাঁর সাথে নায়কের ধারণা ভারতীয় সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার শুরু করল। মূলত পশ্চিম ভারতে, ফলে ভারতীয় পুরাণে ‘কর্মই নায়ক’ এর ধারণা বদলে ব্যক্তি নায়কের ধারণা স্পষ্ট হতে শুরু করল।
কম্ব রামায়ণম (তামিল) :
প্রথম আঞ্চলিক ভাষায় রামায়ণ রচনা হয় তামিল ভাষায়, মুনি কম্বর নামের এক শাস্ত্রজ্ঞ এই রামায়ণটি রচনা করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে তামিলনাড়ুতে পন্ডিত থিরুভাল্লুভার ‘থিরুক্কুড়াল’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সেটি তামিল সংস্কৃতিকে পরবর্তীকালে একটি আকার দেয়। তামিল জাতিসত্বা গঠনে থিরুভাল্লুভারের অবদান সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই গ্রন্থটি, যাকে তামিল বেদও বলা হয়, সেটি আসলে জৈন ধর্ম দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত। তামিল অঞ্চলে জৈন ধর্ম দাবানলের মতই বিস্তার লাভ করেছিল, যাঁর মূল কথা হল সাংসারিক জীবন ত্যাগ করে মোহমুক্ত হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা। আঞ্চলিক রামায়ণে রামের রাজরসের স্থানে যে ভক্তিরস বেশি প্রকট তাঁর সূচনা করেন মুনি কম্বর। তাই তামিল রামায়ণে জৈন ধর্মের মূল বাণী ও ত্যাগ দর্শন বার বার আসে। তাঁর রচিত রামায়ণের নাম ‘রামাবতারম’ যাকে কম্ব রামায়ণ নামেও ডাকা হয়।
জগমোহন রামায়ণ (ওড়িয়া)
উড়িষ্যা তে কবি বলরাম দাস প্রথম উড়িয়া ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। তিনি অব্রাহ্মণ ছিলেন ও সংস্কৃত জানতেন না। তবে তাঁর রামায়ণ উড়িষ্যার জনসাধারণের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একসময় তা স্বার্থান্বেষী পান্ডাদের বিষ নজরে পড়ে। তাঁরা বলরাম দাসের রামায়ণকে শাস্ত্র বিরুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন যে মন্দিরের ভেতর স্থান হবে একমাত্র দেবভাষায় রচিত রামায়ণেরই। কিন্তু উড়িষ্যার জনসাধারণ, মন্দিরের সামনের রাস্তা, যাঁর নাম দণ্ডী, সেখানে বসে বলরাম দাস রচিত রামায়ণ পাঠ করতে থাকেন। তাই একে দণ্ডী রামায়ণও বলা হয়ে থাকে। পান্ডাতন্ত্র তখন চাপ এ পড়ে মূল মন্দিরে না হলেও মন্দিরের সামনের প্রবেশ অঞ্চলে সেই রামায়ণ পাঠের অনুমতি দেয়। এই রামায়ণ যদি মন্দিরে না ঢুকত তবে কী ভবিষ্যতে অবধীতে লেখা তুলসীদাসের রামচরিতমানসের ‘ভগবান’ রাম সম্পূর্ণ দেবত্ব নিয়ে মন্দিরে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন? মনে হয় না! সেখানেই দণ্ডী রামায়ণের সার্থকতা!
শ্রীরাম পাঁচালী (বাংলা)
লক্ষণরেখা, অকাল বোধন ইত্যাদি গল্প ছাড়া শুধু বাংলায় কেন, সমগ্র ভারতেও রামায়ণের গল্প কল্পনাতীত। কিন্তু মজার কথা, এই দুই ঘটনা প্রথম আসে কবি কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ গ্রন্থ থেকে যাকে কৃত্তিবাসী রামায়ণও বলা যায়। এই রামায়ণ বাংলায় সাংঘাতিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ও বাংলার সংস্কৃতি কে প্রভাবিত করে। এই রামায়ণের রাম রাজরস ও ভক্তিরসে সমৃদ্ধ পুরোদস্তুর বাঙালি। তিনি দুর্গা পুজোর পূজা করেন। এটা ভাবা ভুল যে কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে বাংলায় শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। বাংলায় শারদীয় দুর্গা পুজোর সংস্কৃতি অনেক প্রাচীন, কৃত্তিবাস শুধু সাহিত্যিক আঙ্গিকে রামায়ণে তাঁর অবতারণা করেছেন। ভাল করে পড়লে বোঝা যাবে, রামের দুর্গা পুজোয় যে ফুলগুলির নাম উনি উল্লেখ করেছেন, সেটি ভৌগোলিকভাবে বাংলার flora and fauna এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের সাথে তাঁর মিল নেই, তবে বর্তমানে রামের পূজা পদ্ধতিই শারদীয় দুর্গাপূজায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, যা উত্তর ভারতীয় নবরাত্রির থেকে অনেক আলাদা ও স্বতন্ত্র।
রামচরিতমানস (অবধী / হিন্দুস্তানী)
কবি তুলসীদাসকে কৃত্তিবাসের সমসাময়িক বলেই মনে করা হয়। এই তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানস’ হল উত্তর ভারত অর্থাৎ হিন্দুস্তানে রামকে দেবত্ব প্রদানের পেছনে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। লক্ষণরেখা, অকাল বোধন এর মতন ধারণা তুলসীদাস এর রামায়ণেও দেখা গেল, সেখানে বাঙালির বিজয়া দশমী হয়ে গেল শুভ শক্তির জয় এর দিনও রাবণ বধের দিন। ফলে বিজয়া দশমীর দিন উত্তর ভারতে রাবণ দহন উৎসব পালিত হয়। তুলসীদাসের রাম দেবত্বে উন্নীত হবার জন্য তাঁর পূর্বসূরীদের পদচিহ্ন অনুসরণ করেছেন। রামচরিতমানসে নায়ক রামের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি, হতে পারে এর কারণ মুঘল সময়কাল। তখন অব্রাহিমিক ধর্ম-দর্শনের প্রভাব সরাসরি ভারতীয় সাহিত্যে পড়তে শুরু করেছিল। ভারতে প্রতিটি ভক্তির গল্পেই কোন সাধারণ মানুষ ভক্তির মাধ্যমে দেবত্বে উন্নীত হয়। রামায়ণের ক্ষেত্রে এই রূপান্তর দেখা যায় অনেক সময় ধরে সাহিত্যের ন্যারেটিভ বদলাতে বদলাতে যখন রাম দেবত্বে উন্নীত হলেন।
তবে রামায়ণ কার ? বাংলার উপর কী রামকে চাপানো হচ্ছে ?
আসলে রামায়ণ কে যে যেভাবে দেখবে, রামায়ণ তাঁর, রামায়ণ প্রতিটি সংস্কৃতির, মায়ের মুখ থেকে শিশু যে রামায়ণ শোনে, সেটা তাঁর রামায়ণ উপলব্ধির প্রথম ধাপ। যেটা সারা জীবন তাঁর সাথে থাকে। ভবিষ্যতে আমাদের রামায়ণ দর্শনের ভিত সেই ছোটবেলায় মায়য়ের মুখ থেকে নীতিবাক্যের মতন শোনা রামায়ণই গড়ে দেয়। কন্নড় সংস্কৃতিতে রামায়ণের মহিলাদের দিকটি অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে।, কন্নড় সংস্কৃতিতে রামায়ণের লোকগাথার প্রভাব অন্দরমহলে সবচেয়ে বেশি। সেখানে মহিলাদের গানের বিষয় হল, ‘কৌশল্যার গর্ভধারণের সময় তাঁর অনুভূতি’, ‘রামকে কোলে নেবার সময়ে কৌশল্যার অনুভূতি’, ‘সীতার বিরহ’ ইত্যাদি’। অর্থাৎ আমরা যে মহাকাব্যকে পুরুষালী বলি, সঙ্গত কারণেই, সেটা কর্ণাটক এ হয়ে পড়ে নারী আশ্রিত, সেখানে নারী কেন্দ্রিক চরিত্ররা প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
আমাদের বুঝতে হবে যে রামায়ণ unquestionable না। সমস্ত পুরাণকেই প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করা যায়। হিন্দু ধর্মেরই একটি অতুলনীয় শাস্ত্র ‘তর্কশাস্ত্র’ সেই অনুমতি আমাদের দেয়। মাইকেল মধুসূদনের মতে রাম খল, কপট। তাঁর এই কথা বলার স্বাধীনতাও রামায়ণ রক্ষা করে। মালয়লাম রামায়ণে রামের একটি বোন আছেন, যাঁর নাম শান্তা। সীতাকে ত্যাগ করার সময়ে সে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হয়ে তাঁর ভাই রাম কে যা নয় তাই বলে ফেলে। যে প্রাসাদে রামের উপর প্রশ্ন করার কেউ ছিল না, সেখানে তাঁর বোন তাঁর বিবেক দংশন ঘটিয়ে দিল। এই শান্তা আসলে আমাদের সবার প্রতিনিধি, আমরা যে প্রশ্ন গুলো রামকে করতে ভয় পাই, সে অকুতোভয়ে তা বলতে পারে।
বাংলায় রামের পূজা কখনোই সর্বজনীন রূপ পায়নি, তবে এই নয় যে বাঙালি রাম পুজো বিমুখ। বহু বৈষ্ণব রাজা, বিশেষ করে বিষ্ণুপুর, কালনা ও বীরভুমের রাজবাড়ি ও মন্দিরগুলিতে রামায়ণ পেয়েছে অনন্য সন্মান। রাম বেশিরভাগ বৈষ্ণব ক্ষত্রিয়দের কুলদেবতা হয়েই ছিলেন। বাঙালির লোকাচার আশ্রিত ধর্মাচরণের মূল ভাবনা হল, বাঙালি সংস্কৃতিতে দেব দেবীর adaption। এই কারণে আরবী ভাষায় লিখিত কোরানের থেকে বাংলার সংস্কৃতিতে মুর্শিদি গান বেশি গ্রহণযোগ্য। “দুনিয়ায় নবী এল মা আমিনার ঘরে / হাসিলে হাজার মানিক কাঁদিলে মুক্তা ঝরে” এই গানের কথাগুলো বাঙালির কাছে সুরা ও আয়াতের থেকেও বেশি প্রিয়। ঠিক তেমন, উত্তর ভারতে ‘ভগবান রাম’ কিন্তু বাংলার ‘শ্রী রামচন্দ্র জিউ,’ বাঙালির নিজস্ব কুলদেবতা, ঘরের ছেলে। হাওড়ার রামরাজা, গুপ্তিপাড়ার রামঠাকুর, বীরভুমের রামচন্দ্র জিউয়ের সাথে বাঙালির সখ্যতা বহুদিনের। তবে বাংলায় নবজাগরণ ও ব্রাহ্ম আন্দোলন এর যুক্তিবাদী ঢেউ উঠলে বাংলার নারীরা রামায়ণ পাঠে অস্বীকার করেছিল। আধুনিক ভারতে নারীবাদ, লিঙ্গসাম্য ইত্যাদি ধারণা বাংলা থেকেই উঠতে শুরু করলে উনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে রামায়ণ জনপ্রিয়তা হারায় ।
তবে বিজেপির রামে সমস্যা কী? মূর্তির শৈল্পিক ধরনের কথা যদি বাদ দিই, তাহলেও, কোন রাজনৈতিক দল যে রামকে আমার আপনার সামনে রাখতে চায় সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সমগ্র ভারতের ‘রামায়ণ সংস্কৃতি’র সাথে বর্তমান ‘রামায়ণ রাজনীতির ফারাক বিস্তর। গ্রীক দার্শনিক আরিস্টটল বলেছিলেন, “মানুষ রাজনৈতিক জীব।” তাই বিজেপি যে রামকে বাংলায় প্রাসঙ্গিক করতে চায়, সেই রাম আসলে একটি রাজনৈতিক পুতুল, তাঁর মধ্যে দেবত্ব নেই। সে একটি সংস্কৃতির অন্যের উপর আগ্রাসন! কারণ সেই রাম আমাদের রামঠাকুর বা রামচন্দ্র জিউ নয়, সেই রামের পুজোয় খোল করতাল নিয়ে কীর্তনিয়ারা রাস্তায় বের হয় না, পুরুলিয়ার ছৌ শিল্পীরা রাম রাবণের যুদ্ধের অভিনয় করেন না, অথচ গৈরিক তরবারির আস্ফালনে ভয়ের আবহ সৃষ্টি হয়। আমাদের পূজিতা দুর্গা ও কালীর উপস্থাপনাও অস্ত্রসজ্জিত রূপে হয়। কিন্তু দেবী মহামায়ার হাতে অভয় মুদ্রা সেই অস্ত্রের ভয়াবহতাকে ভক্তের কাছে ম্লান করে দেয়। গ্রহণ ও বর্জন ব্যক্তিগত বিষয় হলেও, বাঙালির কাছে সেই রামের গ্রহণযোগ্যতা মাপতে সাংস্কৃতিক দিক থেকে দু’বার ভাবতে হবে বৈকি। এই আত্মসমীক্ষা বাঙালির জাতিগত কর্তব্য।
Discussion about this post