মহাপঞ্চমীর সকাল, মাইকে বেজে উঠল মহিষাসুরমর্দিনী। পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর আনার প্রস্তুতি তুঙ্গে কারণ বাঙালির এক বছরের প্রতীক্ষার পর মা যে আসছেন ধরাধামে। এসব এখন প্রায় অতীত। সময়ের সাথে সাথে প্রতিযোগিতার কারণে বহু মন্ডপে মহালয়া থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা আনার কাজ। তবে কথায় বলে, “দুর্গা পুজো বিশ্বের সব শ্রেণীর বাঙালির ঐতিহ্যের মেলবন্ধন।” তাই তো স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আজও আধুনিকতার থেকে বহু দূরে সাদামাটা পুজোয় মেতে ওঠেন ‘হুলুং’ গ্রামের নিতাই সর্দার ও তার পরিবার। যদিও এই পুজো হয়ে উঠেছে সারা গ্রামের পুজো। গোটা গ্রাম এ পুজোকে ঘিরে সেজে ওঠে উৎসবের সাজে।
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার জেলার হুড়া ব্লকের অন্তর্গত এক প্রত্যন্ত গ্রাম হুলুং। গ্রামের শেষ প্রান্তে রয়েছে সিং সর্দার পাড়া। এখানেই নিতাই সিং সর্দারের বাড়িতে পরম নিষ্ঠার সাথে পূজিতা হন মহামায়া। পেশায় দিনমজুর নিতাই বাবু সারা বছর থাকেন পুরুলিয়া শহরের কেতকায়। সেখানেই সারাবছর কাজ করেন তিনি। অভাবের সংসারে, দিন এনে, দিন খাওয়ার মতোই অবস্থা। তবুও শত আর্থিক অনটনের মাঝেও শরতের সময়ে নিতাই বাবু হুলুং গ্রামের নিজের বাড়িতে আয়োজন করেন মাতৃ আরাধনার।
নিতাই বাবুর এই পুজোর আয়োজনে থাকে না কোন জাঁকজমক বা আভিজাত্য। থাকে শুধুই গৃহকর্তা নিতাই বাবু ও তার স্ত্রীর আন্তরিকতা। পুজোতে ঢাকের কোন ব্যাবস্থা করা হয় না। এছাড়াও এই পুজোয় করা হয় না কোনো প্যান্ডেল, নিতাই বাবুর ছোট মাটির ঘরেই পূজিতা হন দেবী। টালির চালের মাটির এই মন্ডপে লাইট বলতে একটি মাত্র ৪০ ওয়াটের টিউবলাইট। করোনা মহামারীর সময় নিতাই বাবু কর্মহীন হয়ে পড়লেও, কারোর সাহায্য না নিয়েই নিজের মনের জোরে চালিয়ে গিয়েছেন মায়ের পুজো।
নিতাই বাবুর কথায়, “এই পুজো শুরু হয়েছিল প্রায় ৭০ বছর আগে তার দাদুর হাত ধরে। তাই শত কষ্ট সামলেও তিনি পরিবারের এই ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করবেন।” তাই তো হাসি-খুশি নিতাই বাবু সারাবছর অল্প অল্প করে অর্থ জমাতে থাকেন, যাতে মায়ের পুজোয় কোনও ঘাটতি না ঘটে। প্রতিবেশীদের কথায়, “অন্য জায়গার মত লোক জানিয়ে মা এখানে আসেন না। পুরুলিয়ার এই গ্রামে মা আসেন বাড়ির মেয়ের মতোই মেঠো রাস্তা ও শুভ্র কাশের বন পেরিয়ে। গ্রামের সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সর্দার বাড়ির পুজোয়।”
চিত্র ও তথ্য ঋণ – ভাস্কর বাগচী
Discussion about this post