ছানার সাম্রাজ্যে মুকুটহীন রাজা রসগোল্লার শাসন। তবে দূর থেকে যেন হাঁক শোনা যায়,ছানার পায়েসেরও। সেই হাঁক যথেষ্ট জোরালোও বটে। জন্মদিনের পায়েসের পর এই ছানার পায়েসই যা চেটেপুটে খায় বাঙালি। বাঙালির সঙ্গে ছানার পরিচয় যদিও পর্তুগিজদের হাত ধরে। বিদ্বৎজনদের প্রাথমিক পর্যায়ে নাক সিঁটকানো অবশ্যই ছিল। দুধকে বিকৃত করে এমন খাদ্য!রসাতলে চলে গেছে এ সমাজ! তবে সে সবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খোদ বাঙালীই মিষ্টি রসের তলিয়ে দিয়েছে ছানাকে।
ছানাকে নিয়ে বাঙালির পরীক্ষা-নিরীক্ষাও একসময় প্রচুর হয়েছে। উদ্ভাবন হয়েছে একের পর এক নতুন মিষ্টি। রসগোল্লা, ছানার সন্দেশ, ছানার পায়েস ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে চরিত্রের দিক দিয়ে ছানার পায়েস স্ব-বৈশিষ্ট্যযুক্ত। সাধারণত ছানার সংস্পর্শে এলে স্বাভাবিকভাবেই দুধ ফেটে যায়। কিন্তু ছানার পায়েসে এমনটা হয়না। দুধের সরোবরে ছানার মন্ড ভেসে বেড়ালেও দুধ থাকে পরিবর্তনহীন। অবশ্যই সব কেরামতি প্রস্তুতকারকের হাতে। যত দুধ ঘন হবে ততই বাড়বে স্বাদ। কতটা সময় ধরে দুধ ফোটানো প্রয়োজন, কেমন করে মাখতে হবে সেই ছানার মন্ড সবই প্রস্তুতকারকের হাতের খেল। ছানার পায়েসকে আরো সুস্বাদু বানাতে দেওয়া হয় পেস্তা, কাঠবাদাম, জাফরানের স্পর্শ। তবে যদি প্রশ্ন করা হয়, মুখে স্বাদ লেগে থাকার মত ছানার পায়েস কোথায় পাওয়া যায়? উত্তরটা অবশ্যই হবে উত্তর দিনাজপুরের সদর শহর রায়গঞ্জ। এখানকার ছানার পায়েসের ক্যারিশমায় মুগ্ধ তার ভক্তবৃন্দ।
রায়গঞ্জের স্থানীয় মিষ্টি নির্মাতাদের মতে, ওপার বাংলার মিষ্টি প্রস্তুতকারকদের কাছেই শেখা এই মিষ্টি তৈরির মূল প্রণালী।তারপর খানিক নিজেদের ছোঁয়া। এতেই কেল্লা ফতে। তাও সে সব দেশভাগের অনেককাল আগের কথা। কলিযুগের সৌজন্যে দুধে জলের পরিমাণ বেশী থাকবে এতেই যেন খানিক অভ্যস্ত আমরা।তবে মজার বিষয় হল, এখানে মিষ্টি প্রস্তুতিতে দুধে মেশানো হয়না কোনোরকম ভেজাল উপকরণ। এখনও মেনে চলা হয় পুরনো পদ্ধতি। তাতেই যেন জুড়ে যায় বাড়তি স্বাদ।ছানার মন্ড মুখে তুলতেই মনে হবে ভাগ্যিস বাঙালি জাতি ছানাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিল! মিষ্টির পরিমাণ একেবারে যথাযথ, দুধও জমাটি ক্ষীর। রায়গঞ্জের ছানার পায়েসের নামডাক হওয়ার পেছনে যথেষ্টর বেশিই কারণ আছে। দোকানে বিক্রিও হয় তেমনই। ১২-১৩ ঘন্টার বেশীক্ষণ রাখলে ছানার পায়েস নষ্ট হতে শুরু করে। সেই চিন্তা এখানে নেই, সকালে এই মিষ্টি প্রস্তুত করলে তা বিক্রি হয়ে যায় বিকেলের মধ্যেই। আর তাতেই হাসির ঝলকানি দোকান মালিকদের মুখে।ঠিক এই কারণেই দোকানে সবসময় মজুত থাকে টাটকা ছানার পায়েস।
উৎসবের মরশুমে এই মিষ্টির চাহিদাও বাড়ে। শহরের বাইরে থেকেও আসতে থাকে এর অর্ডার। দাম প্রতি কেজি আড়াইশো থেকে তিনশো টাকা। তবে ছানার পায়েসটি মুখে পুরলে দাম একেবারে সুদে আসলে আদায় হয়ে যাবে,তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে জানা যখন হয়েই গেল, কলম্বাসের মতো অভিযানে নেমেই পড়া যাক। যাত্রা হোক রায়গঞ্জের ছানার পায়েসের উদ্দেশ্যে। এই অমৃত আস্বাদনের সৌভাগ্য হোক সবার।
Discussion about this post