“থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়” বহুল ব্যবহৃত প্রবাদ। রান্নায় বৈচিত্র্যহীনতা, জীবনে বৈচিত্র্যের অভাব—এ রকম বোঝাতেই এ প্রবাদ। বাঙালির একদম নিজস্ব খাবার হল বড়ি। খুবই ঘরোয়া একটি খাদ্য উপকরণ। এছাড়াও বাংলার লোকশিল্পের মধ্যেও অন্যতম হল বড়ি শিল্প। শীতকালে বড়ি দিয়ে নানা ধরনের তরকারি, শাক, মাছের ঝোল খাওয়ার চল রয়েছে বাঙালি বাড়িতে। খাদ্যরসিক বাঙালি পাতে একটু বড়ি পেলে কতই না খুশি হয়। আর আমাদের এই বড়ি সাধারণত বাড়িতে দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু যারা সময়ের অভাবে বাড়িতে বড়ি দিতে পারে না তারা বাজার থেকে বড়ি কিনে আনে। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার নৈহাটির অন্তর্গত বড়ি পাড়া। যার আসল নাম আম্রপল্লী। কিন্তু এটি বড়ি পাড়া হিসাবেই বেশি পরিচিত। তার অবশ্য পর্যাপ্ত কারণও রয়েছে।

আশি বা নব্বইয়ের দশকে গ্রামে গ্রামে বড়ি দেওয়ার দৃশ্য ছিল নিয়মিত। শীত এলেই মাসকলাইয়ের বড়ি বানিয়ে সে বড়িকে খোলা জায়গায় রোদে শুকোতে দেওয়ার দৃশ্য খুব একটা ধূসর হয়নি এখনো। কিন্তু বড়ি দেওয়ার সে চলই এখন সীমিত হয়ে গেছে। সাদা ধবধবে সুতির কাপড়ের ওপর দেওয়া সাদা শিশির বিন্দুর মতো ডালের বড়ি ছিল সাদা কাপড়ের ওপর সাদা সুতোয় নকশা বোনা বনেদি জামদানির মতোই সুন্দর শিল্পকর্ম। কিন্তু বড়ি পাড়ায় গেলে সেই শিল্পকর্ম এখনও চোখে পড়বে।

দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রামের প্রায় বেশিরভাগ পরিবার বড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। বড়ি বেচেই চলে তাদের সংসার। এই গ্রামে ডালের বড়ি তৈরির ঐতিহ্য শত বছরের পুরনো। এই অঞ্চলের প্রত্যেকটি বাড়িতে ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায় বড়ি তৈরির কাজ। তারপর, সেই বড়ি রোদে শুকিয়ে প্যাকেজিং করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন বাজারে। এখানে ঢুকলেই চোখে পড়বে মাঠে রোদের মধ্যে সারিবদ্ধভাবে চলছে বড়ি শুকানোর কাজ। প্রায় প্রত্যেকেই ব্যস্ত থাকেন তাঁদের বড়ি তৈরির কাজে। এখানে মুসুর ডাল, বিউলির ডাল, মটর ডাল, চাল কুমড়োর বড়ি সহ সব ধরনের বড়ি তৈরি করা হয়।

জানা গিয়েছে, বিউলি, মসুর, মটর কলাই সহ বিভিন্ন ডাল রাতে জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর তা মেশিনে পিষে নেওয়া হয়। এরপর টিনের পাতের উপর ছোট ছোট করে চৌকো যন্ত্র দিয়ে বড়ি দেওয়া হয়। অনেকে কাপড়ের উপরেও বড়ি দেন। তারপর তা রোদে শুকানো হয়। বড়ি পাড়ায় ডালের বড়ি তৈরির একটি ছোট শিল্প গড়ে উঠেছে। এই শিল্পে প্রায় ১০০০-১৫০০ জন মানুষ জড়িত। এখানে তৈরি ডালের বড়ি কলকাতা শহরের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করা হয়। এছাড়াও, এই বড়িগুলি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি করা হয়। এই এলাকায় ডালের বড়ির স্বাদ ও গুণগত মান অত্যন্ত ভালো। এই বড়িগুলির চাহিদা রয়েছে দেশ-বিদেশে। বড়ি তৈরির জন্য এই এই পাড়াটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রও হয়ে উঠেছে।
চিত্র ঋণ – ভ্রমণ পিপাসু এবং নেইল বণিক
Discussion about this post