ভীম চন্দ্র নাগ, ঠিকানা বউবাজার। ব্যাস এটুকুই; সাধারণ মানুষের কাছে এটা কি তা নিয়ে জিজ্ঞাসা চিহ্ন আসলেও মিষ্টিপ্রেমীর কাছে এটা হলো জান্নাত মানে ইয়ে যাকে বলে কিনা পরম সুখের চাবিকাঠি।। আর ভীম চন্দ্র নাগ মানেই যেটা প্রথম চিন্তার স্রোতে ভেসে আসে তা হলো বিখ্যাত সৃষ্টি ‘লেডিকেনি’। পরাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রীর জন্মদিনে উপহার হিসেবে রসে টইটুম্বুর ভাজা ছানার গোল্লা বানিয়ে দেন ভীম নাগ যা গভর্নর জেনারেল ও তাঁর স্ত্রী এর মন এমন ভাবে জয় করে যে পরে সেই মিষ্টির নামটাই হয়ে যায় গভর্নরের স্ত্রী লেডি ক্যানিং এর নামে – ‘লেডিকেনি’। যাক গে, সে গল্প তো সবারই অল্প বিস্তর জানা। আজকের বিষয়টি এই দোকান নিয়েই, কীভাবে মিষ্টিপ্রেমীর ভালোবাসার অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠলো এটি।। কি তার শুরুটা?
সাল আন্দাজ ১৮২৬ হবে, হুগলী জেলার মনোহরা খ্যাত জনাই থেকে এসে কলকাতার বৈঠক বাজারে ওঠেন পরাণ চন্দ্র নাগ। কলকাতায় এসে তিনি বউবাজারে একখান মিষ্টি দোকান খোলেন কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ দোকানের শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ফলত সেই সদ্য খোলা দোকানের সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সী ভীম চন্দ্র নাগের কাঁধে। ওইটুকু বয়সেই তিনি বাবার হাত ধরে মিষ্টির জাদুকলা অনেকটাই রপ্ত করে নিয়েছিলেন। শিখে নিয়েছিলেন বাবার তৈরি বিশেষ কিছু গোপন রেসিপি। ছানার সাথে কাজু, কিসমিস, পেস্তা, গোলাপ জল ইত্যাদি মিশিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি নানাবিধ রকমারি মিষ্টান্নে দোকান ঘর ভরিয়ে তোলেন। দেখতে দেখতে অল্প কিছুদিনেই বিখ্যাত হয়ে যায় তার এই রসের জাদু সম্ভার। কত রথী মহারথীরা তার দোকানের ভক্ত হয়ে পড়েন সে তালিকা বলে শেষ করার মতো নয়। খ্যাতি বাড়ে নাগমশায়ের মিষ্টি দোকানের। তাঁর দোকানে পায়ের ধুলো পড়ে রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুদের মনও জয় করে নাগ বাবুর অপূর্ব সৃষ্টিকলা।
অবাক করার বিষয় জানবাজারের রাণীমা রোজ নাকি এই দোকানের মিষ্টি আনাতেন তাঁর আরাধ্য রঘুবীরের পুজোর জন্য।এমনকি তিনি যখন দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর দর্শনে যেতেন সব সময় হাঁড়ি ভর্তি মিষ্টি এই দোকান থেকে নিয়ে যেতেন ঠাকুর রামকৃষ্ণের জন্যে। এখানেই ইতি ভাবছেন নাকি? না, না, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এখানের মিষ্টি এতটাই ভালোবাসতেন যে পরে তাঁর নামে এই দোকানে এক বিশেষ মিষ্টি তৈরি হয় যার নাম – ‘আশু ভোগ’। এ ছাড়াও আরোও কত রকমারি লোভনীয় মিষ্টি তৈরি হয় এখানে যার মধ্যে ‘ দিলখুস’,’ প্যারাডাইস’, ‘আবার খাবো’ তো মিষ্টিপ্রেমীর কাছে আবেগের অন্য মাত্রা এনে দেয়। মিষ্টি যদি হয় সুখের কাব্য তাহলে ভীম চন্দ্র নাগ সেই কাব্যের এক অন্যতম লেখক যার সৃষ্টি রসের ছোঁয়ায় মনে শুধু একটাই শব্দ ধ্বনিত হয়,আহা!
চিত্র ঋণ – Justdial
Discussion about this post