ক্যান্সার! দেহের ক্ষতিগ্রস্ত কোষের লাগামছাড়া বিভাজন এবং শেষভাগে মৃত্যু। এভাবেই এই রোগের পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। শেষের অমোঘ দিন ঘনিয়ে আনতে এর জুড়ি মেলা ভার, সে বিষয়ে গোটা চিকিৎসা জগৎ একমত। কিন্তু আজ এমন একজনের কথা লিখতে বসে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে যার ‘শেষভাগে মৃত্যু’ হয়তো লেখা হয়নি কখনও। বরং লেখা হয়েছে গান, আরও গান এবং বারংবার যুদ্ধজয়। সেই যোদ্ধার নাম সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন ওরফে বেসবাবা সুমন।
বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা একজন রকশিল্পী হিসেবে বিখ্যাত, লক্ষ লক্ষ অনুরাগী, সহস্র লাইভ গিগস, বাংলাদেশের রক জগতের পথপ্রদর্শক ‘অর্থহীন’ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। কিন্তু আততায়ী খ্যাতিকে তোয়াক্কা করেনা, তাই আততায়ী হানা দিয়েছে ঘুরে ফিরে। ক্যান্সার। হাড়হিম করে দেওয়া এই মারণ রোগ প্রথমবার তাকে হারাতে আসে মেরুদন্ড তাক করে। দুটো ম্যালিগন্যান্ট টিউমার ধরা পড়ে শরীরে। স্টেজ ওয়ান হওয়ায় সে বার খানিক সহজ নিস্তার জোটে যদিও দীর্ঘ যুদ্ধের পর। সেই একবারই হয়তো মানসিক ভাবে বেসবাবা খানিক দুমড়েছিলেন, ভাঙেননি তবুও। কিন্তু সেই স্থিরতা স্থায়ী হয় মাত্র দশ মাস। তারপর আবার হানা, এবার পাকস্থলীতে, স্টেজ ফোর। এরপর ত্বক থেকে থুতনির ক্যান্সার, এডিসন্স ডিজিজ থেকে পথ দুর্ঘটনা, হানা দিলো সকলেই। কিন্তু হারাতে পারলো না কেউ এ শিল্প সত্ত্বার অস্তিত্বকে। কম করে ১৫ বার সার্জারির ছুরির নিচে শুয়েছেন বেসবাবা, কিন্তু বারবার ফিরে এসেছেন। ধন্যবাদ দিয়েছেন, কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অগণিত ভক্তকুলকে। বলেছেন -“এই যুদ্ধে তোমরা পাশে ছিলে বলেই তো পারলাম, তোমরা আমায় সাহস দিলে বলেই…” সত্যি কি আমরা? আমরা সাহস দিলাম বলেই?
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2020/06/5e6fd993-b6e5-41b5-a977-cef3344d64b9-min.jpg)
ছোট বয়স থেকেই রকস্টারদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন সুমন। চাইতেন তাঁদের মতো গিটার বাজিয়ে জনতাকে মাতিয়ে দিতে! উৎসাহ দেখে মা কিনে দেন একটি হাওয়াইয়ান গিটার। সেই গীটারে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ চলে বছর তিনেক, এরপর সেই গিটার ও সাথে কিছু টাকার বিনিময়ে কিনে ফেলেন একটি স্প্যানিশ গীটার। প্রথমবার পান সেই ভাবে দাঁড়িয়ে গিটার বাজানোর অনুভূতি যা দেখে শিহরিত হয়েছেন বহু বছর। দেখেছেন প্রিয় রকস্টারদের যে ভঙ্গিতে, সে ভাবেই নিজের একলা ঘরের অন্তরালে চলে তার প্রস্তুতি পর্ব। বছর দুই পরে হঠাৎ তার জীবনে ঘটে সেই মহা উত্তরণ পর্ব। ‘Iron Maiden’ এর বেসিস্ট স্টিভ হ্যারিসের লাইভ বাজানোর ভিডিও দেখে সেই মুগ্ধতায় মিশে যান সুমন। ঠিক করে ফেলেন এই হবে তার পরিচয়। বেস গীটার নেই, তবু কোই বাত নেহি, স্প্যানিশ গীটারের নীচের দুটো স্ট্রিং সরিয়ে ফেলে বানিয়ে নেন বেস গিটার। বেসিস্ট সুমন থুড়ি বেসবাবা সুমনের জন্মলগ্ন এটাই। আমরা সাহস দিলাম বলেই?
এরপর তাঁর রকের দুনিয়ায় প্রবেশ বাংলাদেশের আরেক রক মসিহা জেমসের হাত ধরে, ব্যান্ডের নাম ছিলো ‘ফিলিংস’। বছর তিনেক এখানে সেই অ্যাকুয়াস্টিক তারবিহীন বেস বাজানোর পরেই তিনি হাতে তুলে নেন নিজের প্রথম ইলেকট্রিক বেস গিটার। তখন বেসবাবার বয়স প্রায় উনিশ, এই উনিশ বছর বয়সেই একাধিক রক ব্যান্ডে বেসিস্ট হিসেবে সুযোগ করে নেন সুমন। ১৯৯৭ সালে যোগ দেন আরেক বাংলাদেশী রক-মেটাল দৈত্য ‘ওয়ারফেজ’ ব্যান্ডে। এই ভাবে পথ চলতে চলতেই কাটে আরো বছর দুই, আবার সাহসিকতা নাড়া দেয় তার অভ্যন্তর। ৯৯ সালে আসে তার প্রথম নিজস্ব কাজ ‘সুমন ও অর্থহীন’। বাংলাদেশের রক মহলে সাড়া জাগিয়ে তোলে এই নবীন শিল্পীর আলবাম। প্রশংসিত হয় সমালোচক থেকে রক শ্রোতা সকলের কাছেই। সেই থেকেই আনুষ্ঠানিক পথ চলা শুরু ব্যান্ড ‘অর্থহীন’ এর! ভেবে বলুন, আমরা সাহস দিলাম বলেই কি?
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2020/06/69596169-e89c-40ec-ac3d-94acd5168bd8.jpg)
এরপর, সালটা ২০০১, লাইভ কনসার্টে সুমন রকমুগ্ধ করে দিচ্ছেন শ্রোতাদের, আচমকা খেয়াল করলেন চোয়াল বন্ধ করতে পারছেন না তিনি আর, গলা থেকে তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো স্বর সঠিক ভাবে বেরিয়েছিলো সেই অবস্থাতেও। কনসার্ট শেষ করে ছুটে যান হাসপাতালে, চিকিৎসকরা জানান তীব্র ভোকাল ভাইব্রেশন ও স্বরক্ষেপণেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চোয়ালের বেশ কিছু লিগামেন্ট। এমনকি কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গ্যাছে লিগামেন্ট। ডাক্তার স্পষ্ট করে দেন – “এই অবস্থায় কোনোভাবেই আর কখনোই গান গাওয়া যাবে না।” হতভম্ব হয়ে পড়েন সুমন, এ কী শুনছেন তিনি? গান গাওয়া যাবেনা? তাহলে বাঁচবেন কী নিয়ে তিনি? বেরিয়ে আসেন হাসপাতাল থেকে এক দৃঢ় প্রত্যয়ী রককর্মী। কাট টু নেক্সট ইয়ার, চোয়ালবন্ধনী বেঁধে আরো একবার জনতা কাঁপাচ্ছেন সুমন। লাইভ কনসার্টে গেয়ে যাচ্ছেন পরের পর তীব্র রকধর্মী লিরিক্স, অনায়াসে। এবার হতভম্ব হওয়ার পালা চিকিৎসকের। তাঁর বয়ান খানিক এরকম ছিলো – “আমি জানিনা কীভাবে আপনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলছেন, তবে এটা স্পষ্ট বুঝছি যে গান গেয়ে আপনার চোয়ালের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে”। আরো চারবছর, হ্যাঁ, চার বছর এই চোয়ালবন্ধনী ব্যবহার করেই রক কনসার্ট করে যান সুমন। বছর চারেক পর, বিশ্বকে বিস্মিত করে দিয়ে ফিরে আসেন একদিন স্টেজে, চোয়ালবন্ধনী ছাড়াই। কারণ সেটা খুলে দিয়েছেন চিকিৎসক। চার বছর ধরে গাইতে গাইতে ঠিক হয়ে গিয়েছে তার চোয়াল, সেরে গিয়েছে লিগামেন্টের ফাটল। আরেকবার ভেবে বলুন, আমরা সাহস দিলাম বলেই কি তবে…?
একসময় ওজন ছিলো ১৭৪ কেজি, হ্যাঁ, খাদ্যরসিক বেসবাবা একসময় ভুগেছেন ওবেসিটি সংক্রান্ত সমস্যাতেও। তারপর একদিন অঘোষিত যুদ্ধে নেমে পড়েছেন এই অসুস্থতার বিরুদ্ধেও। তখন সালটা ২০০৪। শুরু করে দেন নিয়মিত ডায়েট ও ব্যায়াম। তার কথায় – “যেদিন দেখলাম, ১০-১২ কেজি ওজন কমে গেছে, সেদিন বুঝেছিলাম আমি পারবো”। হ্যাঁ, পেরেছিলেন এবারও, কোমরের সাইজ ৫৮ থেকে ৩২-এ আনতে পেরেছিলেন, দেড় বছরের মাথায় ৯১ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন এবং এয়ারপোর্টে কর্তৃপক্ষের সামনে এটা বোঝাতে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন যে ছবির ব্যক্তিটি আদতে তিনিই, অন্য কেউ নন! এটাও কি ভাবে হলো তবে? আমাদের সাহসে? এরপর তার অসুস্থতার জগতে প্রবেশ করে ক্যান্সার। প্রথমে মেরুদন্ড, তারপর পাকস্থলী, ত্বক, থুতনি। এভাবেই মারণ-রোগ মিছিল বয়ে নিয়ে গিয়েছে একটা শরীরের উপর। নিয়েছেন অজস্র ওষুধ, কখনও বাদ গিয়েছে পাকস্থলীর ৮৫ শতাংশ, চলেছে দীর্ঘ কেমোথেরাপী, কিন্তু যোদ্ধা সুমন হারেননি কোনোদিনই। বরং দেখিয়েছেন বিস্ময়কর মনোবলের পরিচয় বারংবার। এডিসন্স ডিজিজের জন্য তার অস্ত্রোপচার প্রয়োজন ছিলো, অতঃপর প্রয়োজন ছিল অ্যানাস্থেশিয়ার। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জ্ঞান ফেরার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগ, কিন্তু ছুরির নিচে শোয়ার আগেই তিনি বলে দেন – “ডাক্তার আমি বাঁচতে চাই, পরশু ‘Hobbit’ সিনেমাটা রিলিজ করছে, ওটা আমায় দেখতে হবেই!” হ্যাঁ এবং ফিরে আসেন, সিনেমাও দেখেন সুমন। এহেন সুমনের জীবনটাই যেন সেলুলয়েডের পর্দা থেকে তুলে আনা লার্জার দ্যান লাইফের এক কিংবদন্তী।
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2020/06/18221874_10154402514516073_2372294791686341071_n.jpg)
সাম্প্রতিক কালে খবর এলো, আবার অসুস্থতার সঙ্গে যুঝছেন সুমন, তার শরীর ভালো নেই। কিন্তু শেষ সাক্ষাৎকারেও যে তিনি কথা দিলেন নতুন কিছু সাউন্ড নিয়ে আসবেন আবার আমাদের সামনে? হ্যাঁ, আসবেন, আবার ফিরবেন সেই মহাজাগতিক রকতারকা, আবার গ্যালারি ভেসে যাবে আলোর ঝলকানিতে, বেজে উঠবে ‘এপিটাফ’ এর সোলো আরো একবার। এই ভরসা নিয়েই দিন গুনছি আমরা, রককর্মী ও রকশ্রোতারা। দেখলাম ঢাকার দুই যুবক তার উকেলেলে নিয়ে নেমে পড়েছে শুনশান রাজপথে, আকুল গলায় গাইছে – “যদি কোনোদিন হঠাৎ করে পড়ে মনে/আমার লেখা গানগুলো যা ছিলো তোমার জন্যে”! এপারে, আমার তিলোত্তমা কলকাতায় নিঝুম রাতের অন্ধকারে হেডফোনে মিশে নেমে যাচ্ছে একটা আর্ত সঙ্গীত – ‘ক্যান্সারের নিশিকাব্য’। এরপরের ঘোলাটে মধ্যরাতে প্রচন্ড রকম ভাবনা আসে এই ব্যক্তিকে নিয়ে, বুঝে উঠিনা পুরোটা কিন্তু ভেবে যাই ঘন্টার পর ঘন্টা। ‘cancer bassbaba sumon’ সার্চ করে উদ্বিগ্ন মন যদি খোঁজ নিতে চায় বেসবাবার, সে খোঁজ পাবেনা। পাবেনা সহানুভূতি মাখা হাজারো আর্টিকেল বা রোগশয্যার ইতিহাসও, কিন্তু পেয়ে যাবে আরো একটা গান। যে গান জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর কথোপকথনকে ডকুমেন্টেড করে এক রকজীবনের, যে গান চিৎকৃত এবং দুর্বার, যে গান সটান জানায় যুদ্ধ আমি জিতবোই, হোক না যতই প্রতিপক্ষ আর গানের নাম ‘ক্যান্সার’। শিল্পী সেখানে নিজের পাশাপাশি গাইতে দিচ্ছেন ক্যান্সারধর্মী চরিত্রটিকেও, যেন মুখোমুখি সংঘাতে শেষ বিচার পেতে চান রকের মঞ্চেই।
আমরা “সাহস দিলাম বলেই” হোক আর নাই হোক, ফিরে আসুন তিনি, তাঁকে এখনো প্রয়োজন শিল্পের জন্য, শিল্পীর জন্য এবং প্রজন্মের উন্মেষনের জন্য, প্রয়োজন সেই আঠেরটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং আরো সাতটি প্রতিষ্ঠানের কর্মনির্বাহী কর্তা সুমনকে। প্রয়োজন সেই রকব্যক্তিত্বকে যিনি আবার ফিরে এসে এগারোটা স্ক্রুতে বিদ্ধ শিরদাঁড়াটা সোজা করে দাঁড়াবেন উদ্বাহু হয়ে সেই মাইক স্ট্যান্ডটির সামনে আরো একবার মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে গেয়ে যাবেন –
“হারিয়ে যাই নি
এখনো চলছে এই হৃদপিন্ডটা
এখনো আমি স্বপ্ন বুনি তোমায় ছাড়া
হারিয়ে যাই নি
এখনো আছে বাকি সময় কিছুটা
হয়তো হবে তুমি অদৃশ্য আমায় ছাড়া
থাকবে না তোমার কোন চিহ্ন আর”
বেসবাবা, আপনাকে দেখে আমি সাহস পাই, প্রজন্ম গিটার তোলে কাঁধে, খাতা কলম খুলে লিখতে বসে পরবর্তীর রকসঙ্গীত। আপনাকে দেখে শিখি কীভাবে জীবন যুদ্ধে মাথানত না করে লড়ে যেতে হয়, বদলে ফেলতে হয় নিজের ঘরানা আর সঙ্গীত কৌশল। আপনার দ্রুত সুস্থতা কামনা করে প্রার্থনা করতে পারি, সাহস দিতে পারার ‘সাহস’ হয়তো এ জীবনে হয়ে উঠবে না। কারণ এই সুখী ন্যাকা প্রজন্মের আমরা যে এমনিতেই শিরদাঁড়াটা সোজা রাখিনা, এগারোটা স্ক্রু নিয়ে সেই শিক্ষা যিনি দিয়ে যাচ্ছেন, তাকে সাহস যোগাই কোন ধৃষ্টতায়?
Discussion about this post