“The pen is the tongue of the hand; a silent utterer of words for the eye.” – Henry Ward Beecher. প্রযুক্তির উন্নতি যতই হোক না কেন কলমের বিকল্প খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যদিও এই কলমের আবিষ্কার, একে মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তোলা এসব মোটেই সহজ ছিল না। কলম এক সময় ছিল বিলাসদ্রব্যের তালিকায়। কলম মূলতঃ দুই ধরণের। এক, ‘ফাউন্টেন পেন’ বা ‘ঝর্ণা কলম’। দুই বল পয়েন্ট কলম। এই বল পয়েন্ট পেনই লেখালেখির দৃশ্যপট একেবারেই বদলে দিয়েছে। কিন্তু বল পয়েন্ট কলম নিয়ে বলতে গেলে ফাউন্টেন কলম নিয়ে না বললে ঠিক যেন জমে না। তাই ফাউন্টেন কলম দিয়েই আপাততঃ যাত্রা শুরু করা যাক।
ফাউন্টেন কলমে তরল কালি ব্যবহার হত যা শুকোতে সময় লাগত। তাই দ্রুত কোনও লেখার কাজ শেষ করা যেত না। এ ছাড়াও কাগজকে হতে হতো পুরু। লেখার পরে যদি কোনওভাবে হাতের ঘষা খেত তাহলে তরল কালির জন্য সেই লেখা ঘেঁটে যেত। আরও এক সমস্যার জন্ম হল এই কলম ধরার কায়দা নিয়ে। যাঁরা এই কলমে লেখায় অভ্যস্ত ছিলেন তাদের মতে সমতলের সাথে ৪০-৫৫ ডিগ্রী কোণ করে কায়দা করে ধরে লিখতে হত। এর আবার এক গাল ভরা নাম ও ছিল- ‘Sweet Spot of Fountain Pen’।
এসব কারণেই ফাউন্টেন কলমের বিকল্প সহজ, গতিশীল কিছু ব্যবস্থার কথা অনেকেই ভাবতে শুরু করেন। ১৮৮৮ সালে জন লাউড প্রথম বল পয়েন্ট কলমের পেটেন্ট দাখিল করেন। আমেরিকান এই ব্যাক্তি ছিলেন পেশায় একজন আইনজীবী। আইন চর্চার পাশে পাশেই তাঁর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে খুঁটিনাটি কাজ করার বিশেষ শখ ছিল। ফাউন্টেন পেনের অসুবিধার কারণে তিনি এমন কিছু একটা বানাতে চেয়েছিলেন যা খুব সহজে ব্যাবহারেরযোগ্য এবং সহজে কাঠ, কাগজ বা চামড়ার ওপরেও লেখা যাবে।
তেমনই এক ডিজাইন লাউড তৈরি করেন। আমরা এখন যে বল পয়েন্ট কলম ব্যাবহার করি তার মাথায় একটি ছোট স্টিলের বল থাকে। কাগজে লেখা চালিয়ে যাবার সাথে সাথে এই বল অনবরত ঘুরতে থাকে। ফলতঃ সেটি কালির সংস্পর্শে এসে নিজেই কালি টেনে বের করে নিয়ে আসে। লাউড তাঁর পেটেন্টে ফাউন্টেন কলমের একটু উন্নত সংস্করণ হিসেবেই এই ডিজাইন প্রকাশ করেন। কারণ তাঁর তৈরি এই কলমে ব্যাবহার করা কালিও তরল। সেটি দিয়ে চামড়া বা কাঠে লেখা গেলেও পাতলা কাগজে লেখাটা খুব সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। আর তাই তাঁর এই পেটেন্ট অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারায়। মানুষ আবার পেন্সিলের দিকেই ফিরে যেতে শুরু করে।
১৯৩০ সালে অস্ট্রিয়ান-আর্জেন্টাইন লাজলো বিরো নামে এক সাংবাদিক বল পয়েন্ট কলম নিয়ে একটি সমাধানে এসে পৌঁছন। তাঁর মতে পাতলা তরল কালিতে যখন বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে না তখন কালিকে হতে হবে ঘন। ঘটনাচক্রে এই লাজলোর ভাই ছিলেন একজন দন্ত চিকিৎসক ও রসায়নবিদ। ভাইয়ের সাথে অনেক শলাপরামর্শ করে লাজলো ঠিক করেন যে তরল কালির সাথে আঠা মিশিয়ে ঘন করতে হবে। কিন্তু এতেও এক নতুন সমস্যা, কালি ঠিক করে বেরোতে চায় না। আবার শুকিয়েও যায়। শেষ পর্যন্ত দুই ভাই এই সিদ্ধান্তে এযেন যে এই আঠালো কালি থাকবে এক নলে আর নলের আগায় থাকবে ওই বল। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্য কালি নিচের দিকে আসতে থাকবে আর বলটি বার বার ঘুরে অল্প অল্প কালি বার করবে যা পাতলা কাগজের ওপর লেখার সাথে সাথেই শুকিয়ে যাবে। লাজলো বিরো আর তার ভাইয়ের এই প্যাকেজটি ছিল লাউডের থেকে আলাদা। তাই তো বিরো তার এই কাজের জন্য ১৯৩৮ সালে নতুন করে আবার পেটেন্ট পান। ১৯৩৮ পেটেন্ট পেলেও দুই ভাইয়ের কাছে বল পয়েন্ট কলমের বিশালাকার উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। ইহুদী বলে যথেষ্ট নিপীড়িত হয়ে দুই ভাইকে পালিয়ে যেতে হয় আর্জেন্টিনায় ১৯৪১ সালে। সেখানে গিয়ে ‘বিরোম’ নামে এই বল পয়েন্ট কলম উৎপাদন করতে শুরু করেন দুই ভাই।
অল্প কিছুদিনেই এই ‘বিরোম’ কলম নজর কাড়ে ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের। অধিক উচ্চতায় যেখানে ফাউন্টেন কলম কাজে আসে না সেখানে পেন্সিলের বদলে নতুন জায়গা করতে থাকে এই ‘বিরোম’ কলম। ব্রিটেন রয়্যাল এয়ার ফোর্সের কাছে থেকেই প্রথম সব থেকে বেশি অর্ডার আসে, ৩০,০০০ কপির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। পরিবর্তন আসে কলমের গঠনেও। ১৯৪৫ সালে আমেরিকান ব্যবসায়ী মিল্টন রেনল্টস সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকাতে এই বল পয়েন্ট কলম বিক্রি হবে। ফাউন্টেন পেনের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এক অনবদ্য জায়গা করে নেয় মানব জীবনে। আর আজকের সেই বল পয়েন্ট কলম ছাড়া পুরো দুনিয়া অচল। আপনার টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকা অত্যন্ত অযত্নের জিনিসটির জন্মের ইতিহাসটা আসলে ছিল এতটাই দুর্গম।
Discussion about this post