ভবানীপুর অঞ্চলে, এলগিন রোড আর চৌরঙ্গী রোডের ক্রসিংয়ের কাছে অনেকগুলো সোনার-রূপার গয়নার দোকান দেখা যায়, যার প্রত্যেকেই নাম শুরু ‘লক্ষীবাবুর সোনা রূপার গয়নার দোকান’ বলে। এমন কিন্তু নয়, যে একই মালিকানায় সব দোকান! বরং প্রতিটি দোকানের মালিকানা আলাদা। কয়েকটা দোকান আবার নামের সাথে ‘আসল’, ‘পুরাতন’ এইসব শব্দও জুড়ে রেখেছে! এই জিনিসটা আমাকে ছোটবেলা থেকেই খুব অবাক করতো! বিষয়টা নিয়ে একটু খোঁজ খবর নিতে, বেরিয়ে পড়ল এক ব্যবসায়ী বাঙালির গল্প, যার নাম লক্ষীনারায়ণ সেন অথবা লক্ষীনারায়ণ দাস।
ঘটনার শুরুটা কিন্তু হয়েছিল বহু আগে, যখন ব্রিটিশরা দ্বিতীয় ফোর্ট উইলিয়াম বানানো শুরু করে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। ওই সময়ে গোবিন্দপুর অঞ্চলে (বর্তমান ময়দান অঞ্চল) অনেক ব্যবসায়ী বাঙালির বসবাস ছিল। তাদের সরকার থেকে পুনর্বাসন দেওয়া হয় নানান অঞ্চলে। লক্ষ্মীবাবুর সংসারে আসলের আসল নাম অর্থাৎ খাঁটি ২৪ ক্যারটের নামটি হল লক্ষ্মীনারায়ণ সেন৷ এই লক্ষীনারায়ণ ছিলেন গালার ব্যবসায়ী। তারও গোবিন্দপুরের বসতবাড়ি ফোর্ট বানানোর জন্য অধিগ্রহণ করে তৎকালীন ইংরেজ সরকার। তাঁকে পুনর্বাসন দেওয়া হয় চৌরঙ্গী অঞ্চলে (মোটামুটি আজকের এলগিন রোডের আশে পাশে)। এই লক্ষীনারায়ণ বাবু তখন একটা নতুন ব্যবসা খোলেন। ওই সময়ে প্রচুর বিহারী ও হিন্দুস্থানী লোক তীর্থ করতে কালীঘাট আসতো। তাই তিনি একটা চটি (অনেকটা অতিথিশালার মতো) খোলেন রাস্তার পাশে, তীর্থযাত্রীদের রাত্রিবাসের জন্য। অবাঙালি তীর্থযাত্রীদের মুখে মুখে, লক্ষীনারায়ণ হয়ে যান লক্ষীবাবু। ওনার কাছেই তীর্থযাত্রীরা সোনা-গয়না গচ্ছিত রেখে তীর্থভ্রমণে যেতে থাকেন, কারণ ওই সময়ে চোর-ডাকতের প্রচন্ড উপদ্রব ছিল তীর্থপথে।
লক্ষীবাবুর চটির যথেষ্ট সুনাম হয় দিনে দিনে। এর পরে উনি একটা সোনা-রুপার দোকান খোলেন, যার নাম পরবর্তীকালে লোকমুখে হয়ে যায় ‘লক্ষীবাবুর সোনা রুপার দোকান’। নিজের সততার জন্য, এই ব্যবসাতেও লক্ষীনারায়ণ অনেক বিখ্যাত হন। এর ফলে, অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে লক্ষীবাবু হয়ে ওঠেন কোলকাতার সোনা-রুপার ব্যবসাতে এক ভরসাযোগ্য ব্র্যান্ড। আগেই বলেছি, লক্ষীনারায়ণ বিখ্যাত ছিলেন তার সততার জন্য। পরবর্তীকালে ওই অঞ্চলে আরো সোনার দোকান হয়, প্রত্যেকেই ওনাকে অনুরোধ করে, তার ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করার জন্য। তিনি সকলকেই অনুমতি দেন নিজের নাম ব্যবহারের জন্য। এই কারণেই আজ ওই অঞ্চলে প্রায় ১০-১২টি সোনার দোকানের নাম লক্ষীবাবুর নামে, আর প্রত্যেকেই দাবি করে তাদেরটাই আসল ও প্রাচীন! এই দোকানগুলোর মালিকানা বাঙালি ও অবাঙালি, দু’রকম লোকজনের হাতেই রয়েছে।
কয়েকটা দোকানে দেখলাম এক ভদ্রলোকের ছবি টানানো আছে, যাকে ওনারা লক্ষীবাবুর ছবি বলছেন। কিন্ত সোনার দোকানের ভিতরে ছবি না তুলতে পারার জন্য, সেটা সংগ্রহ করতে পারলাম না। কিন্তু সংগ্রহ করলাম এক অতি সাধারণ বাঙালি ব্যবসায়ীর, একটা সোনা-রুপার দোকানের ব্র্যান্ড হয়ে ওঠার গল্প। কে বলে, বাঙালি ব্যবসা করতে জানে না?
Discussion about this post