প্রায় সব বাঙালির খাদ্যতালিকায় যা শীর্ষস্থান দখল করে আছে তা হল মিষ্টি। কোনো শুভ কাজের সূচনাতেই হোক কিংবা বিজয়ার উদযাপনে শুভেচ্ছা জানানো, বাঙালির মিষ্টি চাই-ই চাই। “আমি বৌবাজারের লোক মশাই। আর পেশায় ডাক্তার। তাই মিষ্টিও খাবো, ইনসুলিনও নেব।” বাঙালির মিষ্টি প্রেম বোঝার জন্য বিধান রায়ের এই মন্তব্যই বোধহয় যথেষ্ট। আজ এমন একটা মিষ্টির ইতিহাস জানাবো যার জন্ম বাংলায় না হলেও শক্তিগরের ল্যাংচা বা বর্ধমানের সিতাভোগ মিহিদানার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজ স্বাদের জোরেই বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির তালিকায় ও মানুষের মনে করে নিয়েছিল নিজের স্থান মোরব্বার কথা বলছি। যা আমাদের উত্তর ভারতে ‘পেঠা’ বলেও পরিচিত। রাজ্যের অন্য প্রান্তে অল্পবিস্তর মিললেও বীরভূম জেলার সিউড়ি ‘মোরব্বা হাব’ নামে পরিচিত।
আরবি ভাষায় মোরব্বাকে বলা হয় ‘মুরাব্বা’ যার অর্থ জ্যাম বা ফল সংরক্ষণ। এই মিষ্টি তৈরী হয় চাল কুমড়ো, বেল, শতমূলী, আম, গাজর, পেঁপে, আপেল ইত্যাদি নানান ফল ও সবজি দিয়ে। এগুলো ছাড়াও রয়েছে আদা মোরব্বা। যা আদা, চিনি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয়। বমি ভাব বা অন্যান্য অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য তামিলনাড়ু, কেরাল, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ইত্যাদি অঞ্চলে এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। জানা যায় দক্ষিণ ককেশাসে মোরব্বা তৈরী হত স্ট্রবেরি, চেরি ও নানা স্থানীয় ফল দিয়ে। জর্জিয়ানরা যখন ভারতে আসেন তখন তারা মোরব্বা তৈরীতে আমের ব্যবহার শুরু করেন। যা পরবর্তীতে গুজরাটিদের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় মিষ্টিতে রূপান্তরিত হয়।
আবার আসি সে কথায় যে বীরভূমের সিউড়ি কীভাবে পরিণত হল মোরব্বা হাবে। ইতিহাস আমাদের জানায় ১৭১৮ সালে বীরভূমের রাজনগরের নবাব বদির উদজ্জামাল বেনারস, আগ্রা, লক্ষৌ ইত্যাদি স্থানে ভ্রমণে যান। সেখানে গিয়েই তিনি প্রথম স্থান পান মোরব্বার। মুগ্ধ হন স্বাদে, যে মুগ্ধতা সূচনা করেছিল বীরভূমের এই বিখ্যাত মিষ্টান্ন ইতিহাসের। এর সঠিক স্বাদ বজায় রাখতে তিনি বেনারস থেকে আনিয়েছিলেন মোরব্বা তৈরীর কারিগর। এই মিষ্টি তৈরীর জন্য জঙ্গল থেকে হরিতকি, আমলকী, বেল, শতমূলী ইত্যাদি নিয়ে আসা হত। মোরব্বা তৈরীর সময় ফলকে জলে সেদ্ধ করে চিনির পাক দেওয়া হয়। এটা চিনির পাকে বেশকিছুদিন ভালো থাকে। এতে কোনরকম প্রিজার্ভেটিভ মেশানো হয় না বলেই এর আসল স্বাদ থাকে অক্ষুণ্ণ। স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সিউড়িতে এই মোরব্বা ব্যাবসা শুরু করেছিলন সজনীকান্ত দে। শুধু সাধারণ মানুষই নন, আমাদের পরিচিত বহু মুখই সিউড়ির মোরব্বার স্বাদ চেখে দেখেছেন এবং তৃপ্ত হয়ছেন। সেই তালিকায় আছেন পি সি সরকার, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে অনুপকুমারের মতো অভিনেতারা। এমনকি উত্তম কুমারের জন্যও এখান থেকেই গিয়েছে মোরব্বা। তবে বর্তমানে শিউড়ির গুটি কয়েক দোকানেই মেলে এই মোরব্বা।
Discussion about this post