কথায় আছে মা-ঠাকুমার হাতের রান্নায় যাদু আছে। তা আছে বৈকি! হাল-আমলের হোটেল-রেস্টুরেন্টের দৌলতে বিভিন্ন অঞ্চলের খাবারের স্বাদ আমরা পেয়েছি ঠিকই কিন্তু বর্তমান স্মার্ট ফোনের যুগে সময়ের অভাবে আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোকেই প্রায় ভুলে যেতে বসেছি। এই কারণ বশতঃ আজকাল বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের আঞ্চলিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে চেয়েছেন দুনিয়ার কাছে। ঠিক সেভাবেই এই গ্রাম বাংলার আঞ্চলিক রান্না ইউটিউবের মাধ্যমে দেশ পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে সুদূর চীনে, এক ঠাকুমার হাত ধরে। বোলপুর থেকে ইলামবাজার যাওয়ার রাস্তায় একটি প্রত্যন্ত গ্রাম বনভিলা। এই গ্রামেই থাকেন ৮২ বছরের পুষ্প রাণী সরকার। ইনিই সেই ইউটিউবের জনপ্রিয় ঠাকুমা যার রান্না খাবারের স্বাদ পৌঁছে গিয়েছে দেশ বিদেশে। খড়ের ছাউনি দেওয়া রান্নাঘরে বসে বিভিন্ন পদ রান্না করেন এই পুষ্পরাণী। আর সেই রান্নারই খ্যাতি ছড়িয়ে পরেছে বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা মানুষের কাছে।
এবার আসা যাক কিভাবে প্রত্যন্ত গ্রামের এই ঠাকুমা ইউটিউবের জনপ্রিয় ‘স্টার’ হয়ে উঠলেন, এর পিছনে আছে কারই বা হাত। পুষ্পরানির বড় নাতি কাজল সরকারের কথায় তার বেশিরভাগ সময় কাটে ইউটিউবে দেশ বিদেশের রান্নার রেসিপি দেখে। কিন্তু সেখানে তিনি সেরকমভাবে আঞ্চলিক গ্রাম বাংলার রান্না খুঁজে পাননি। এখান থেকেই ওনার ইউটিউব চ্যানেল খোলার ভাবনা। তিনি এই চ্যানেলের নাম দেন ‘ভিলফুড ব্লগ’। এইভাবেই ২০১৭ সালের জুলাই মাস থকে শুরু হয় তাদের যাত্রা। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা। বর্তমানে যা সাড়ে ১৫ লাখ সাবস্ক্রাইবারে এসে দাঁড়িয়েছে। ইউটিউব সংস্থার পক্ষ থেকে এই চ্যানেলকে ২০২০ সালে দেওয়া হয় ‘গোল্ডেন প্লে বাটন’ সম্মান। ঠাকুমার রান্না রেসিপির ভিডিও আপলোড করেই বছরে প্রায় ৮-১০ লক্ষ টাকা আয় করে এই চ্যানেল।
দেশীয় গ্রাহকই শুধু নয় এই চ্যানেলে চীনা গ্রাহক সংখ্যাই প্রায় ৪৬ হাজার। এছাড়াও বাংলাদেশ, আফ্রিকা, তুরস্ক, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের মানুষের মধ্যেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে ঠাকুমার রেসিপি। এ পর্যন্ত ৪ হাজারেরও বেশি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে ভিলফুড ব্লগে। এই চ্যানেল এরই মধ্যে এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যে ভিডিও আপলোড করা মাত্রই তা দেখে ফেলে প্রায় ১ লাখ দর্শক। ঠাকুমার কথায়, “আমি রাঁধতে ভালোবাসি। তবে কোনও দিন ভাবতে পারিনি মানুষজন আমকে চিনতে পারবে এই রান্নার জন্য! আনন্দ হয় নাতিদের জন্য। দুই নাতি, কাজল আর সুদীপ্ত আমার রান্নার ভিডিয়ো ছড়িয়ে দিয়েছে দেশ-বিদেশে। অনেকে ফোন করে রেসিপি জানতে চান। অনেকের ভাষা বুঝতে পারি না। তবে সকলেই জানতে চায় কোন রান্না কীভাবে বানাতে হয়। আমি তাঁদের শুধু বলি ভিডিওটা দেখ।”
ঠাকুমার তৈরি অতি সাধারণ গ্রাম বাংলার রেসিপিই বেশি পছন্দ করেছেন দর্শকরা। যেমন কাঁচকলার কোপ্তা, বিভিন্ন পদ্ধতিতে তৈরি ইলিশ, পুকুর থেকে ধরে আনা জ্যান্ত রুই কাতলা, কুমড়ো বা শালুকের বড়া, লাউ ঘন্ট, কচু শাক আরও কত কী! ঠাকুমার খড়ের ছাউনি দেওয়া রান্নাঘরে শীল নোড়ায় বাটা মশলায়, নিজের বাগানের সব্জিতে আর গনগনে আঁচে রান্না করা একের পর এক পদ বাংলার সীমানা পেরিয়ে যে দেশ বিদেশে পৌঁছে গিয়েছে। ঠাকুমার কথায় তিনি যে ওনার গ্রাম বাংলাকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন, এত ভালোবাসা পেয়েছেন দেশ বিদেশের মানুষের কাছ থেকে, এটি তার কাছে অনেক বড়ো প্রাপ্তি।
Discussion about this post