সালটা ১৯৩৫। ওপার বাংলার বিক্রমপুরে তখন দুর্ভিক্ষ। গ্রামের সমস্ত মানুষ তখন অনাহার বা অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। গ্রামেরই দরিদ্র এক পরিবারের বড় সন্তান হোসেন। বাবা মারা গেছেন দূর্ভিক্ষে। না খেতে পেয়ে দিন কাটছে তাদেরও। উপায় না পেয়ে ষোল বছর বয়সেই ছোট ছোট কটি ভাই-বোন এবং মায়ের মুখে কিছু খাবার তুলে দেওয়ার আশায় ঢাকায় চলে আসে সে। পুরাতন ঢাকার সিক্কাটুলী এলাকায় সিক্কা তৈরীর ছোট একটি কারখানায় কাজ পেল সে। সিক্কা কথার অর্থ সিকি (চার আনা পয়সা)। সেখানের উপার্জিত অর্থ পুরোটাই সে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিত। সেই কাজ করতে করতেই হোসেন ভাবল ভোর বেলায় যে কিছু ফাঁকা সময় পাওয়া যায় তখন উপার্জন কিছু করা যায় কিনা! হঠাৎ তার মাথায় খেলে গেল এক ব্যবসার বুদ্ধি।
ঢাকার মহল্লার মসজিদের পাশেই ছিলো নিতাই বাবুর সেলুন। জাতে হিন্দু। তবুও হোসেন সাহস করে নিতাই বাবুকে গিয়ে বলল, “কাকা বাবু, আপনার দোকানের সিঁড়িতে আমি খাবার বেচতে চাই”। শুনে এক কথায় রাজি নিতাই বাবু। জবাব দিলেন, “তুই ব্যবসা করবি ভালো কথা। তবে ভোর বেলায় কর যখন দোকান বন্ধ থাকবে। না হলে তোর ব্যবসার কারণে আমার খদ্দের আসাটা বন্ধ হয়ে যাবে।” এ যেন বিড়ালের ভাগ্যে শিঁকে ছেড়া! রাজি হল হোসেন। সালটা তখন ১৯৩৯। এক হাড়ি খাসীর বিরিয়ানি দিয়েই ভোর বেলা নিতাই বাবুর দোকানের সিঁড়ির ওপর বসে ব্যবসা যাত্রা শুরু করল হোসেন। সেখানের মুসলিমরা ফজরের নামাজ পড়ে ফেরার পথে বিরিয়ানি কিনে নিয়ে ফিরতেন। সেইসময় কাগজ ছিলো বেশ মূল্যবান। তাই গাছের পাতার ঠোঙ্গাতেই মুড়ে দেওয়া হত সেই বিরিয়ানি। ধীরে ধীরে বেশ ভালোই এগিয়ে যেতে লাগল সেই ব্যবসা। এক হাঁড়ি থেকে আরেক হাঁড়িতে পরিমাণ বাড়তে লাগল। এমনকি চাহিদা এতটাই বাড়তে লাগল যে কিছুদিন পর থেকে সন্ধ্যা অর্থাৎ মাগরিবের পরও সেই সিঁড়ি উপর ব্যবসা চলতে শুরু করল। পসার বাড়তেই গ্রাম থেকে মা এবং ভাই-বোনদেরকে ঢাকায় নিয়ে এল সে।
এরপর এল সেই সময়। ১৯৪৭, দেশভাগ। হিন্দু নিতাই বাবুকে ফিরে আসতে হবে ভারতে। নিতাই বাবু তখন হোসেনকে বললেন, তিনি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছেন। তাঁর দোকানটা যেন হোসেন কিনে নেয়। হোসেন তখন তাঁকে জানায় সেই মূহুর্তে দোকান কেনার মত টাকা তার কাছে নেই৷ শুনে নিতাই বাবু জানান আপাততঃ হোসেনের কাছে যা রয়েছে তাই দিয়ে যেন সে দোকানটি কিনে নেয়। কারণ সে দোকান অন্য কারোর হাতে তুলে দিতে মন চাইছিল না নিতাই বাবুর। এরপর সেলুনটি কিনে নেয় হোসেন। তার ব্যবসা তখন এক চিলতে সিঁড়ি থেকে উঠে এল দোকানে। পরে হাতে কিছু টাকা জমলে নিতাই বাবুর বাকি পাওনা টাকা অবশ্য কলকাতার ঠিকানায় পাঠিয়েও দিয়েছিল হোসেন।
সেই ভদ্রলোকের পুরো নাম হাজী মোহাম্মদ হোসেন। আর বহু বছর আগের হোসেনের সেই ব্যবসাই আজ পুরাতন ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের বিখ্যাত ‘হাজীর বিরিয়ানী’ হিসাবে পরিচিত। বরাবরই ঐতিহ্যবাহী বৈশিষ্ট্যে সাজানো ছিল সে দোকান। হাজী সাহেবেকে অনেকেই উপদেশ দিতেন দোকানে মডার্ন ডেকোরেশন করতে এবং দোকানে সারাদিন ব্যবসা করতে। ব্যবসা বাড়ানোর তাগিদে বিভিন্ন জায়গায় শাখা খোলার কথাও বলেন তারা। কিন্তু হাজী সাহেব তা করেননি। তিনি বরাবর বলে এসেছেন, “আমি কাকা বাবুর স্মৃতি ধরে রাখতে চাই। আমার মাথায় কোনও শাখা করার পরিকল্পনা নেই। আমি চেয়েছিলাম নাজিরবাজারের মুসল্লীদের ফজর-মাগরীবের পর খেদমত করার।” তবে শাখা না বাড়ালে কি হবে, হাজীর সেই বিরিয়ানির চাহিদা সারা বাংলাদেশ জুড়েই। ১৯৯২ সালে মারা যান হাজী সাহেব। তবে তাঁর বিরিয়ানির চাহিদা কিন্তু এতটুকুও কমেনি। শুধু ঢাকাই নয়, তার বাইরেও বহু দূর থেকে বহু লোক ছুটে আসেন এই বিরিয়ানির টানেই। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ বিরিয়ানির প্রশংসায় পঞ্চমুখ! তবে এই সমস্ত কিছু বাদ দিয়ে এ কথা বলা যেতেই পারে, এই বিরিয়ানির ইতিহাসে মিশে রয়েছে এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। এক হিন্দুর এক মুসলিমের পাশে থেকে দুঃসময়ে তাঁকে সাহায্যের কথা। আর সে সাহায্যের খাতিরেই হাজী সাহেবের প্রতিদানের কথাও। হাজী বিরিয়ানির স্বাদ এবং চাহিদা ছাড়িয়েও তাই ওপার বাংলার বাতাসে এখনও লেগে রয়েছে সেই সম্প্রীতির গন্ধই।
কভার চিত্র ঋণ – thewanderlust.com.bd
Discussion about this post