পুরুলিয়ার দুর্গম অযোধ্যা পাহাড়ের কোল, চারদিকে ঘন অরণ্য। তারই মাঝখানে একটা গ্রাম, তার নাম জিলিংসেরেং। সেখানে দিন গড়ায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে। পাঁচ বছর আগে এই গ্রামে বিয়ে হয়ে এসেছিল একটি মেয়ে। এই সাঁওতাল গ্রামে এসে সে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হল, গ্রামে মানুষের মধ্যে শিক্ষার অভাব তাকে চিন্তিত করে তুলল। গ্রামার অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর আর পড়াশোনা করে না, কারণ নিকটবর্তী স্কুলে পৌঁছাতে হলে ঘন জঙ্গল ভেদ করে প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। ফলে পঞ্চম শ্রেণীর পরেই থেমে যায় শিক্ষার যাত্রা। এই অবস্থায় নীরব থাকতে পারেনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ এই নববধূ। সে করে দেখিয়েছে এক অসাধারণ কাজ। তার নাম মালতী মুর্মু।
স্বামীর সহযোগিতায় মালতী গ্রামের শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছে এক প্রাণের পাঠশালা। মাটির দেওয়ালে মাথার উপর টিন দিয়ে ঝুপড়ি। ঝুপড়ির দেওয়ালে সাদা চক দিয়ে আঁকা ব্ল্যাকবোর্ড, আর মাটিতে চট পেতে বসার জায়গা। কোলে নিজের শিশুসন্তান নিয়ে প্রতিদিন সেখানে উপস্থিত হন মালতী আর ভালোবাসা দিয়ে শিশুদের পড়ান। তাঁর মুখে শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, জীবনের আলোও জাগ্রত হয়। এখানে অলচিকি লিপির পাশাপাশি শেখানো হয় বাংলা ও ইংরেজি। পড়ুয়াদের কাছে সবকিছুই অবৈতনিক। মালতী স্বামীর সাথে শহরে গিয়ে বই, খাতা, পেন কিনে নিয়ে আসেন। বর্তমানে তাঁর এই ছোট্ট স্কুলে পড়ুয়া সংখ্যা ৪৫। পরবর্তীকালে বেশকিছু স্বেচ্ছ্বাসেবী সংস্থার সাহায্যও তিনি পেয়েছেন। মালতী চান আগামী দিনে এই পাঠশালায় কম্পিউটার শিক্ষা দিতে। প্রতিটি দিন তিনি লড়াই করে যাচ্ছেন অদম্য আশার আলো বুকে নিয়ে।
মালতী মুর্মু আজ কেবল একজন শিক্ষিকা নন, তিনি আদিবাসী সমাজের গর্ব। পাহাড়-অরণ্যে ঘেরা অজ পাড়াগাঁয়ে তিনি যেন প্রজ্বলিত এক দীপশিখা, যিনি ছড়াচ্ছেন শিক্ষার আলো। তাঁর সংগ্রাম, স্বপ্ন ও নিষ্ঠা আজ অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে গ্রামবাসীর কাছে। এই অন্ধকারময় গ্রামীণ জীবনে মালতী যেন আলোর দূত, যিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন, কিভাবে সামান্য উপকরণ দিয়েও কত কী করা যায়। ইচ্ছাশক্তি যদি দৃঢ় হয়, তবে শিক্ষার মশাল জ্বালিয়ে তোলা যায় অরণ্যের গভীর অন্ধকারেও।
মালতী মুর্মু বিশ্বাস করেন, শিক্ষা ছাড়া আদিবাসী সমাজের প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। তাই তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছেন তাঁর বিদ্যালয়ে এবং অভিভাবকদের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বহু আদিবাসী ছেলে-মেয়ে আজ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। তাঁর কাজ শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি গ্রামীণ মহিলাদের আত্মনির্ভর করতে বিভিন্ন ধরনের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করেছেন। তাঁরা যাতে হস্তশিল্প, কৃষিকাজ ও অন্যান্য আয়ের পথের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, সেই চেষ্টায় তিনি নিরলস পরিশ্রম করেন। ফলে অনেক মহিলা নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন। আজ মালতী মুর্মু কেবল একজন সমাজকর্মী নন, আদিবাসী সমাজের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবন ও কর্ম অন্যদের অনুপ্রেরণা দেয়।
Discussion about this post