ইতিহাসের মোড়কে জড়ানো ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব, মাহেশের রথযাত্রা। ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর শহরের মাহেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই উৎসব। ইতিহাসের হিসাবে এই বছর পা দিল ৬২৪ বছরে। রথযাত্রার দিন শ্রীরামপুরের মাহেশের জগন্নাথ দেবের মন্দির থেকে মাহেশ গুন্ডিচা মন্দির অর্থাৎ মাসীর বাড়ি অবধি রথ টেনে নিয়ে যান অগণিত ভক্ত৷ উল্টোরথের দিন সেই রথটিকেই আবার মূল মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। শ্রীরামপুর তথা সারা বাংলাতে ছড়িয়ে রয়েছে ছয় শতাব্দী প্রাচীন এই উৎসবের মাহাত্ম্য। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘রাধারাণী’ উপন্যাসের মূল প্রেক্ষাপটও কিন্তু মাহেশের এই রথ উৎসব।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা প্রাচীন ইতিহাস। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায় কথা উঠে এল সেইরকমই কিছু ইতিহাসের কাহিনী। ধ্রুবানন্দ নামে এক সাধক জগন্নাথের সেবা-পূজো করার ইচ্ছে নিয়ে পুরী যান। সেখানে মহারাজাকে গিয়ে তাঁর বাসনার কথা বললেন ধ্রুবানন্দ। রাজা বললেন, মন্দিরের মূল পুরোহিতের অনুমতি এক্ষেত্রে আবশ্যক। তখন ধ্রুবানন্দ পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মূল পুরোহিতকে সব কথা খুলে বলেন। তবে পুরোহিত তাঁকে সেবা-পূজা করার অনুমতি দিলেন না। দুঃখে এবং হতাশায় ধ্রুবানন্দ প্রাণত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। সেই সময় জগন্নাথ তাঁকে স্বপ্নে মাহেশ ফিরে গিয়ে গঙ্গাতীরে অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি মাহেশ ফিরে তো এলেন, কিন্তু এদিকে প্রভুর তো কোনও দেখাই মেলে না। তিনি ফের অনশনে বসলেন। এরপর এক বর্ষণমুখর রাতে গঙ্গাবক্ষে ভেসে এলো তিনটি নিমকাঠের খণ্ড। সেই দিয়েই বানানো হল জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি।
ইতিমধ্যেই ধ্রুবানন্দের বয়সও যথেষ্ট বেড়েছে। কার হাতে প্রভুর দায়িত্ব দিয়ে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে একদিন তিনি দেখলেন, গঙ্গায় চৈতন্যদেব তাঁর দ্বাদশ গোপাল নিয়ে বজরায় যাচ্ছেন। কাঁসর-ঘণ্টার আরতি শুনে তিনি মন্দিরের দিকে এলেন। সেই দেখে ধ্রুবানন্দ মনে মনে নিশ্চিন্ত হয়ে দেহত্যাগ করলেন। চৈতন্যদেবের দ্বাদশ গোপালের পঞ্চম গোপাল ছিলেন কমলাকর পিপলাই। চৈতন্যদেবের নির্দেশে তিনিই এই জগন্নাথ মন্দির তৈরির ব্যাবস্থা করেন। শ্যামবাজারের নয়নচাঁদ মল্লিক ধর্মপাল মূল মন্দিরটি তৈরি করে দেন। ৬২৩ বছর ধরে সেই নিমকাঠের মূর্তিরই পুজো হয়ে এসেছে মাহেশে। পুরোহিত মশাই আরও জানালেন, একপাকেই জগন্নাথের ভোগ রান্না হয় এবং কোনও তেল-মশলা চলে না। সেদ্ধ গঙ্গাজলে সৈন্ধব লবণের ভোগ রান্না হয়ে থাকে।
রথযাত্রার কারণ হিসেবে আরও একটি জনশ্রুতিও কিন্তু বহুল প্রচলিত। রথের দিজ জগন্নাথ দেব যে মাসীর বাড়ি যান, তিনি কিন্তু তাঁর রক্তের সম্পর্কের মাসী নন। তিনি ছিলেন এক সাধারণ ভক্ত। আশা করে ছিলেন তাঁর বাড়িতে একদিন জগন্নাথদেবের পায়ের ধুলো পড়বে। সেই ভক্তের মনস্কামনা পূর্ণ করতেই প্রতি বছর তাঁর বাড়িতে যান জগন্নাথ দেব। মন্দিরে থাকাকালীন পুরোহিত ছাড়া কেউ ছুঁতে পারেন না জগন্নাথকে। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ প্রভুকে যাতে ছুঁয়ে দেখতে পারেন সেই কারণেই প্রতিবছর রাস্তায় নামেন তিনি। করোনা আবহে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যদিও এবছর বন্ধ রথযাত্রার এই উৎসব। তবু আগামী বছরে জগন্নাথদেবকে একবার ছুঁয়ে দেখার আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন তাঁর অগণিত ভক্ত।
Cover Picture Courtesy – SMP Photostory Creator
Discussion about this post