“দাদা, একটু চা- টা হবে নাকি?”- সকাল হোক বা বিকেল, বাঙালির চায়ের সঙ্গে একটা ‘টা’ না জুড়লে ঠিক জমে না। আর এই ‘টা’ টা যদি হয় বেকারির মচমচে বিস্কুট তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আবার একটু হালকা খিদে মেটাতে বেকারির একটুকরো পাউরুটি বা একটা কেক যেন একাই একশো! হার মানাবে দামি দামি পেস্ট্রি- প্যাটিসকে, কী বলেন? আশি বা নব্বই দশকের ছেলেপুলেদের কাছে এসব তো নস্টালজিয়াও বটে। তখন বেকারির এই ছোটো ছোটো নস্টালজিয়াই পেটের থেকে বেশি মন ভরিয়ে রাখত সকাল – বিকেল। তবে জানেন কী, বেকারির এই জনপ্রিয়তা কিন্তু আজকের নয়। জড়িয়ে রয়েছে একখানা ইতিহাসও। চলুন, ইতিহাসের মোড়কে মোড়া বাঙালির রোজকারের সঙ্গী এই বেকারির প্রচলন সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক দু’এক কথা।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে তখন বইছে স্বদেশী হাওয়া। চারিদিকে তখন বিদেশি জিনিস বর্জন করে দেশীয় উপায়ে কিছু জিনিস তৈরির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। তাই সেসময় বিদেশিদের প্রিয় খাবার অর্থাৎ কেক – বিস্কুটই বা বাদ থাকে কেন? এসব ইতিমধ্যে বিদেশিদের হাত ধরে ভারতে ভালোই জনপ্রিয় হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে তাই দেশীয় কারিগরের ছোঁয়ায় শুরু হল দেশীয় বেকারির পথ চলা। এ প্রসঙ্গে আচার আচরণে ঘোরতর দেশপ্রেমিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, “পয়সা খরচ করে বিলিতি বিস্কুট খাওয়ার চেয়ে মুড়ি খাওয়া ভাল।” তার ঘোর আপত্তি ছিল বিদেশি বিস্কুট খাওয়া নিয়ে। এই কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরই মন্ত্রশিষ্য শরৎচন্দ্র ঘোষ প্রতিষ্ঠা করে বসলেন দেশীয় বেকারি। নাম ‘আর্য বেকারি এ্যান্ড কনফেকশনারী’।
তাঁর গুরুর মত শরৎচন্দ্র ঘোষ নিজেও বিশ্বাস করতেন যে দেশের স্বাধীনতার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হওয়াটাও জরুরি। তাই দেশীয় এই বেকারির ব্যবসাকে পোক্ত করার জন্য নিজের বাড়িতেই ময়দা দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পাউরুটি তৈরি করে করেছিলেন তিনি। এরপর একটি জার্মানি ‘হাবাম্ফা’ মিক্সিং মেশিন এবং দুটো ছোট ছোট ফায়ার ব্রিকের তৈরি তন্দুর নিয়ে শুরু করেন বেকারি ব্যবসা। এরপর থেকেই বিদেশি বেকারির একচেটিয়া জনপ্রিয়তার পথে ছেদ পড়ে।প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি বিপ্লবীরা দাবি করেন, আর্য বেকারির পাউরুটি এবং কে সি বোসের বার্লি ছাড়া খাবেন না তাঁরা। বাধ্য হয়ে তাই মেনে নেন ব্রিটিশ সরকার। শুধু তাই নয়, কলকাতায় শীতকালীন জাতীয় কংগ্রেস বসলে খোদ নেতাজি ডাক পাঠান আর্য বেকারির উত্তরাধিকারী সুধাংশুকুমার ঘোষকে। সেখানকার স্বেচ্ছাসেবক দল তথা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর জলখাবার হিসেবেও বেছে নেওয়া হয় আর্য বেকারির তৈরি পাউরুটি, কেক-পেস্ট্রি। সকলের প্রশংসায় দেশীয় এই ব্যবসাই ধীরে ধীরে পৌঁছে যেতে লাগল জনপ্রিয়তার শিখরে।
পরে শরৎচন্দ্র তার ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন বড় ছেলে সুধাংশুচন্দ্র ঘোষের উপর। নিজস্বতার গণ্ডি পেরিয়ে শরৎচন্দ্র এই ব্যবসাকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন দেশবাসীর মধ্যেও। তিনি দেশীয় এই বেকারি শিল্প সম্পর্কে প্রচারের জন্য একটি বইও লিখেছিলেন ‘পাশ্চাত্য পাকপ্রণালী ও বেকারী দর্পণ’ নামে। এখানেই শেষ নয়, দেশের মানুষকে উৎসাহিত করতে ১৯৩৪ সালে চক্রবেড়িয়ায় একটি বেকারি ট্রেনিং কলেজ পর্যন্ত খুলে ফেলেন তিনি। ব্যস! এইভাবেই বিদেশি বেকারির জনপ্রিয়তাকে সরিয়ে স্বদেশী বেকারি একটু একটু করে জায়গা করে নিতে থাকে গোটা দেশবাসীর হৃদয়ে।
Discussion about this post