আষাঢ়ের কালো মেঘ আকাশ ঢেকে ফেললে বঙ্গদেশে রথযাত্রা হয়। বঙ্গদেশ বলতে কেবল পশ্চিমবঙ্গ ধরলে চলে না। ধরতে হয় প্রাচীন উৎকল তথা উড়িষ্যাকেও। শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা হয়। মেদিনীপুরেও বসে রথের মেলা। তবে মেদিনীপুরের রথ বললেই চোখে ভাসে মহিষাদলের নাম। তারই কোলঘেঁষে যে আরো কত রথের মেলা বসে! আমরা তার হিসেব রাখি না। সেরকমই একটি হল সুতাহাটার রথ।
সুতাহাটা একতা পরিষদ এই রথের মূল উদ্যোক্তা। ২০১৫ সালের গোড়ার দিকে জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় এখানে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে বসে রথের মেলা। শাল ও সেগুন কাঠে তৈরী প্রায় ৩৬ ফুট উঁচু রথকে টানা হয়।রথে থাকে মোট ৯টা চুড়া। চাকা থাকে ১৬টা। রথের গায়ে আঁকা থাকে দেবতার রঙিন প্রতিমূর্তি। সবই স্থানীয় শিল্পীর কাজ।এই রথ বানাতে সময় লেগেছিল মাস দুয়েক। খরচা হয়েছিল তিরিশ লাখ।
উড়িষ্যার রীতি মেনেই এখানকার রথযাত্রা সম্পন্ন হয়। প্রথমে হয় স্নানযাত্রা। ১০৮ টি স্বর্ণ কলসের জলে স্নান করেন জগন্নাথদেব। তারপর জ্বর আসে তাঁর। দিন পনেরো তাই অন্তর্ধানে থাকতে হয়। তখন কেবল সেবায়েতকেই দর্শন দেন তিনি। দুর্বাঘাসের রস, শতমূলের রস ইত্যাদি দিয়ে সেবা করেন সেবায়েত। দৈনিক তেল মালিশও করতে হয় তাঁর। এবার লেদ উৎসব হলে তিনি জাগ্রত হন। অতঃপর প্রতিষ্ঠিত হন। তখনই ব্রাহ্মণ রথযাত্রার আয়োজন শুরু করেন। রথের দিন সকাল পাঁচটায় শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করেন দেবতা। তারপর হয় মঙ্গলারতি। আরতি হয়ে গেলে সাত আট জন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, রথের পুজো শুরু করেন। এরপর হয় ছেঁড়াফোঁড়া উৎসব। এটি বেশ মজার। স্থানীয় রাজামশাই মন্দির প্রাঙ্গণ ঝাঁট দেন। সেই ঝাঁটা কিন্তু সোনার তৈরি। তবেই রথের চাকা গড়ায়।
সুতাহাটার জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রা পুরী থেকে এসেছেন। সাথে করে এনেছেন বিমলা দেবীকে। তাঁর মন্দির পাশেই। আর সংলগ্ন শিবমন্দিরের যিনি ভোলেবাবা তিনি আগে থেকেই সুতাহাটায় থাকতেন। জগন্নাথদেবের ভোগ প্রথমে জগন্নাথ মন্দির পরে বিমলা মন্দিরে আসে। তারপর সেই মহাপ্রসাদের নাগাল পায় জনগণ। লাবণ্য প্রভা বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠেই মন্দির। সেখান থেকেই রথযাত্রার শুরু। রথ টানা হয় মাসির বাড়ি অবধি। মাসির বাড়ি তথা গুন্ডিচা মন্দির কাছেই। সুবর্ণজয়ন্তী ভবন সংলগ্ন সামন্ত পরিবারে। প্রায় দশ দিন ধরে মাসির বাড়ির মাঠে মেলা বসে। মেলায় পাখি নিয়ে আসে পাখিওয়ালা। কতরকমের যে পাখি থাকে সেখানে! টিকিট কেটে পাখি দেখতে হয়। কেনা যায় না কিন্তু। স্থানীয় লোকে তাই একে পাখি মেলা বলে। পুরীতে রথ টানা শুরু হলে তবেই সুতাহাটায় শুরু হয়। ওপরে বসেন সারথি। সামনে ও পেছনে থাকে রথের দড়ি। টানেন অগনিত ভক্ত। রথ খুব আস্তে চলে। কেউ যাতে দেব দর্শন থেকে বঞ্চিত না হন তাই এ ব্যবস্থা। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান নির্বিশেষে রথ টানেন। অনেকে বলেন দেহই রথ। আত্মা সারথি। আর অন্তর্যামী স্বয়ং অন্তর। তারই রূপক রথযাত্রা। সুতাহাটার রথযাত্রায় ভিড় জমান অসংখ্য মানুষ। তাঁরা কি তবে আত্মদর্শনের লোভেই পথে নামেন! তা জানা যায়নি অবশ্য।
Discussion about this post