যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ ! হ্যাঁ যুদ্ধ শুরু হয়েগেছে ! তবে মানুষের সাথে মানুষের নয়, দেশের সাথে দেশের নয়। তাহলে কোনো কল্পবিজ্ঞানের প্রাণীর সঙ্গে? আজ্ঞে না। তাহলে কোনো ভীন গ্রহের জীবের সঙ্গে? সম্ভবতঃ না। তাহলে কার সাথে? মানুষের সাথে একটা ৮০-২০০ এমএম ভাইরাসের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বোমা-গুলি, পিস্তল-কামান লাগেনা। লাগে লোহার ছুঁচ, প্লাস্টিকের জামা-প্যান্ট, কাপড়ের মুখোশ, হাত শুদ্ধির রাসায়নিক, শ্বাস নেওয়ার বায়ু এবং সারি সারি বিছানা। যুদ্ধ হচ্ছে। মরা-বাঁচার লড়াই চলছে। অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজটাই যুদ্ধের সাইরেন। ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরাই যুদ্ধের সৈনিক। আর হাসপাতালগুলি গোলাবারুদের ডিপো অর্থাৎ মানুষের শেষ ভরসা। এমনই এক হাসপাতালের উল্লেখ না করলেই নয়। বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম হাসপাতাল, ১৮৬০ এর দশকে যে প্রায় একা লড়াই করেছিলো ভয়ঙ্কর ‘বর্ধমান জ্বরের’ বিরুদ্ধে। আজকের এই বিশ্বমানবের যুদ্ধেও সে শ্রীরামপুর ও সংলগ্ন এলাকার মানুষের জীবন রক্ষক, শ্রীরামপুরের ‘ওয়ালশ হাসপাতাল’।
শ্রীরামপুরের প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কবিরাজিতেই রাজি ছিল মানুষ প্রথম প্রথম। বংশ পরম্পরায় যারা এই চিকিৎসা করতেন তারা ছিলেন বৈদ্য। শ্রীরামপুরের অদূরে ছিলো এই বৈদ্যদের বাটি, নাম যার বৈদ্যবাটি। মুসলিমদের জন্য ছিলো হাকিমী চিকিৎসা। এছাড়া তন্ত্র, যাদু, তাবিজ, কবজ, ঝাড়-ফুক, তুকতাক, জল পোড়া, তেল পোড়া এসব তো ছিলই। তবে এই আকাল কাটে আধুনিক যুগে। ইউরোপীয়দের হাত ধরেই শ্রীরামপুরে পশ্চিমী অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার প্রচলন হয়। দিনেমার সরকার ও শ্রীরামপুর মিশনারীদের এই ব্যাপারে অবদান অনস্বীকার্য।
১৮৩৪-৩৫ সালে শ্রীরামপুর তথা ফ্রেডরিকনগরের দিনেমার গভর্নর জে. রেখলিং, ডঃ মার্শম্যান, চিকিৎসক ডঃ ডয়েট এবং আরও অনেকে একটি সভা করেন। সেখানে তাঁরা একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। সভায় ১,৪০০ টাকা দান সংগৃহীত হলো এবং ১,৮০০ টাকা বার্ষিক চাঁদা ঠিক করা হল। দিনেমার কোম্পানীর গঙ্গা তীরবর্তী পরিত্যক্ত গুদামঘরে ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডরিকের জন্মদিনে ২৮ জানুয়ারী ১৮৩৬ সালে শ্রীরামপুরের প্রথম চিকিৎসালয় স্থাপিত হল। এটি ছিলো বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীন হাসপাতাল। দিনেমার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চিকিৎসক জে. ভোইগট্ ওই চিকিৎসালয়ের প্রথম চিকিৎসক হন। ১৮৩৮ সালে গুদামঘরটি বিক্রি হয়ে যায়। তখন একটি পুরনো বাড়ি ভাড়া করে চিকিৎসা কেন্দ্রটি চালু রাখা হল। চিকিৎসা কেন্দ্রের সীমিত জায়গা কী করে বাড়ানো যায় তাই নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা হতে থাকল। দেখা গেল কাছাকাছি একটি পরিত্যক্ত মন্দির লাগোয়া অনেকটা খালি জমি জায়গা পড়ে আছে। পরিত্যক্ত মন্দির সমেত মোট ১২ বিঘা জমি দিনেমার প্রশাসন কিনে দেলে। ১৮৪২ সালে প্রায় এক হাজার টাকা ব্যয় করে সুন্দর একটি নতুন চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। দিনেমার রাজ চিকিৎসা কেন্দ্রের জন্য বার্ষিক ৫৩৩ টাকা ৫ আনা ৪ পাই সাহায্য দিতেন যা ১৮৮১ সাল পর্যন্ত চালু রেখেছিলেন। চিকিৎসা কেন্দ্রের স্থায়ী চিকিৎসক হিসাবে ১৮৪৪ সালে ডাক্তার এ্যাবট যোগদান করার পর চিকিৎসা কেন্দ্রটির প্রসার ঘটল। ২৫০-৩০০ জন রোগীর থাকবার ব্যবস্থা ছিলো। দিনেমার সরকারের স্থায়ী চিকিৎসক বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করতেন। দেশীয় সহকারী চিকিৎসক পেতেন মাসিক দশ টাকা। ১৮৪৫ সালে শ্রীরামপুর ইংরেজদের অধীনে আসার পর এই হাসপাতালের নাম হয় ‘ওয়ালশ হাসপাতাল’।
তৎকালীন সমাজে অনেকের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে হাসপাতালে গেলে রোগী আর জীবিত অবস্থায় ফিরে আসেনা। ছাই পাশ বিলিতি ওষুধ খাওয়ার চেয়ে কবিরাজি বড়ি খাওয়া অনেক মঙ্গলের। এই অভ্যাস লোকে সহজে ত্যাগ করতে পারেনি। এর মধ্যেই ১৮৬০এর দশকে হুগলী জেলায় কুখ্যাত ‘বর্ধমান জ্বর’ বা ‘ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া’-র প্রাদুর্ভাব দেখা যায় যা ক্রমেই মহামারীর রূপ নেয়। বহু মানুষের মৃত্যু হয়। জনসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। তখন বাপবাপ বলে সবাই হাসপাতালে ছোটে। সেই সময় হুগলী জেলার অন্যতম চিকিৎসালয় হিসেবে লড়াই করেছিলো শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতাল। ইউরোপীয়দের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে একসময় কেবল বিলিতি ডাক্তারগণই চিকিৎসা করতেন। ক্রমশঃ পালাবদল হতে থাকে। ভারতীয় তথা বাঙালি ডাক্তাররাও অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারী শিখতে আরম্ভ করেন। বৈদ্যবাটির মধুসূদন গুপ্ত প্রথম ভারতীয় হিসাবে শব-ব্যবচ্ছেদ করেন। আর তখন থেকেই ভারতীয়দের অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্রে যোগদান শুরু।
পরবর্তীকালে ১৮৭০ সালে চিকিৎসা কেন্দ্রটি শ্রীরামপুর পৌরসভার নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে আসে। ১৯০৬ সালে নন্দলাল গোস্বামী, কিশোরীলাল গোস্বামী, রাজেন্দ্রলাল গোস্বামী, রাধিকালাল গোস্বামী প্রমুখরা তাদের মাতৃস্মৃতির জন্য গোবিন্দসুন্দরী ডিসপেনসারী এবং ১১,০০০ টাকা দানে হাসপাতালে দূর থেকে আসা রোগীদের জন্য একটি বসবার ঘর তৈরী করেদেন। মাণিকলাল দত্ত মহাশয়ের দেওয়া অর্থে পুরাতন চক্ষু চিকিৎসা কেন্দ্র ভেঙে সেখানে গড়ে ওঠে নতুন চারতলা ভবন।
পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় এই মহকুমা হাসপাতালটিকে বিভিন্ন বিভাগে উন্নত করা হয়। যেমন মেডিক্যাল, শল্য চিকিৎসা, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ, পরিবার পরিকল্পনা ও মাতৃমঙ্গল, শিশু রোগ, নাক কান গলা, দত্তরোগ, চক্ষু রোগ, অস্থিরোগ, চর্ম রোগ, এস টি ডি (যৌনরোগ), আপৎকালীন বিভাগ (এমারজেন্সী), রঞ্জন রশ্মি (এক্সরে), প্যাথোলজিক্যাল বিভাগ, অবেদন (অ্যানেস্থেশিয়া) বিভাগ, বক্ষরোগ (যক্ষা) বিভাগ, ময়না তদন্ত (মৰ্গ) বিভাগ, ফিজিওথেরাপি, হোমিওপ্যাথি বিভাগ। এছাড়া রয়েছে ব্লাড ব্যাঙ্ক যা ১৯৮০ সালে স্থাপিত হয়। এই হাসপাতালের কে.বি ওয়ার্ড (কানন বিহারী) আগে পৌরসভা পরিচালিত একটি পূর্ণাঙ্গ স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি চিকিৎসার হাসপাতাল ছিল। পরবর্তীকালে সেটি ওয়ালশ হাসপাতালের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে প্রায় ৫৩ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা খরচ করে হাসপাতালে ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন একটি সুপার স্পেশালিটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে অপথ্যালমোলজির (চক্ষু চিকিৎসা) পাশাপাশি মেডিসিন, শল্য চিকিৎসা, স্ত্রী-রোগ, শিশু বিভাগ এবং রোগ-নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উন্নত পরিষেবা পাচ্ছেন রোগীরা।
এই হাসপাতালে বহু চিকিৎসক, অচিকিৎসক কর্মী কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন। ডাঃ কমলাপতি সেনগুপ্তর নাম বিশেষ করে স্মরণে আসছে। তিনি সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন বলে শুধু নয়, একজন এম বি ডাক্তার হয়ে সার্জিক্যাল, গাইনী এবং ই এন টির বহু শক্ত অপারেশন দক্ষতার সঙ্গে করতেন। ফলে তিনি এখনো কিংবদন্তী হয়ে আছেন। ডাঃ মল্লিকের নামও রয়েছে ওই তালিকায়। ওঁরা ছাড়াও সুবোধ দত্ত, নগেন ঘোষাল, বিমল দাশগুপ্ত, সন্তোষ দত্ত, মিলন কৃষ্ণ রায়, গোবিন্দ মুখার্জি, নৃত্যগোপাল চক্রবর্তী, মনোতোষ মুখার্জি, অসিত দত্ত, কৃষ্ণা রায়, রাজকুমার গাঙ্গুলী, শ্রীকান্ত সাহা, পি এল চৌধুরী, বিমলকান্তি সরকার, অতসী সরকার, রামসুরথ পণ্ডিত, বিমল সিংহ, বিশ্বনাথ ঘোষ (বিশুদা), রত্না দে নাগ, তারক সমাদ্দারগণ আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন রোগী ও সহকর্মীদের মধ্যে।
অনেকে মনে করেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতা পরস্পর বিরোধী, এক সাথে থাকতেই পারবেনা। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে শ্রীরামপুরের স্মারকগুলি যেন এই গতানুগতিক চিন্তাধারাকে একদম বদলে দিয়েছে। আধুনিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে পুরাতন ভবনগুলিতে ইতিহাস যেন শহরে ফিরে ফিরে আসে। তার সাথে সাথে যদি মানুষের জীবনও রক্ষা করা যায় তাহলে তো কথাই নেই। যদিও এই হাসপাতাল সম্বন্ধে ভুক্তভোগীদের যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। তবুও প্রায় ১৮৫ বছর যাবৎ সাধারণ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে নিজের কর্তব্য ঠিকই পালন করে চলছে ওয়ালশ হাসপাতাল। এটি শ্রীরামপুরের ঐতিহ্য, শ্রীরামপুরের রক্ষক, শ্রীরামপুরের গর্বও বটে।
Discussion about this post