পরাধীন ভারতের যুগপুরুষ ও স্বাধীন ভারতের জীবন্ত জীবাশ্মের মেলবন্ধন কলকাতার প্রথম তেতলা লালবাড়ি রাইটার্স বিল্ডিং। যুগের সাথে বদলেছে শাসক, বদলায়নি শুধু রাইটার্স বিল্ডিংয়ের প্রতিটা ইটের গায়ে লেগে থাকা শাসনতন্ত্রের দাগ। সেই সুদূর ব্রিটিশ আমলের কথা। সেই সময় কলকাতার চৌরঙ্গীতে অনেক বড়ো বড়ো ইমারত থাকার দরুন কলকাতার ওপর নাম হয়ে ওঠে সিটি অফ প্যালেস। যদিও আমরা কলকাতাকে সিটি অফ জয় বা সিটি অফ কালচার নামে বেশি চিনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকাল হোক কিংবা বর্তমান সরকারের মহাকরণ, সেই দীর্ঘদিনের পরাধীন ভারতীয়দের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও নির্বাক দাড়িয়ে আছে কলকাতার প্রথম তেতলা সেই লালবাড়ি রাইটার্স বিল্ডিং।
সালটা হলো ১৭৫৬ , রাইটার্স বিল্ডিংয়ের জন্মলগ্নের ঠিক আগের মুহূর্ত। সেই সময় কলকাতা আক্রমণ করেন সিরাজদ্দৌলা। ইংরেজদের সাথে তুমুল যুদ্ধের ফল হিসেবে ধ্বংস হয়ে যায় সেই সময়ের বিখ্যাত চার্চ ‘সেন্ট এন্ত্র’। যা পরবর্তীতে আর পুনঃনির্মাণ করা হয়নি। বরং ১৭৭৬ সালে সেই স্থানে জুনিয়র ক্লার্কদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কারণ তখন কোম্পানির কেরানীদের কাজ অনেক বৃদ্ধি পায়। তাদের একত্রিত করতেই কোম্পানির এই উদ্যোগ। সেই সময় করণিকদের ‘রাইটার্স’ বলা হতো। আর তাদের নামানুসারেই এই তিনতলা বাড়ির নাম রাখা হয় রাইটার্স বিল্ডিং। গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এই বিল্ডিং নির্মাণের গুরুভার দেন থমাস লিয়নকে। না তিনি কোনো বড়ো মাপের স্থপতি ছিলেন না। তিনি মূলতঃ কলকাতায় এসেছিলেন এখানকার কাঠের মিস্ত্রিদের ইওরোপিয়ান ধাঁচে কাঠের নির্মাণ শেখাতে। তাই তো কলকাতার প্রথম তেতল বাড়িটি কোনো নকশা ছাড়াই গড়ে উঠেছিল। তবুও তিলোত্তমা থমাস লিওনকে ভোলেনি। আজও রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পিছনের রাস্তাটি লিওন রেঞ্জ নামে খ্যাত।
ইতিহাসের জীবন্ত জাদুঘর রাইটার্স বিল্ডিং সম্পর্কে যতই বলা যায়, ততই শব্দ কম পড়ে। এটি তৈরির কাজ চলে ১৭৭৬-১৭৮০ সাল পর্যন্ত। জুনিয়র ক্লার্কদের আবাসন হিসেবে প্রধানত মূল ব্লকটি ১৭ বিঘা জমির ওপর একই রকম দেখতে ১৯টি অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে গড়ে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে এটি ইংরেজদের উপনিবেশিক কার্যালয় পরিণত হয়। কাজের সুবিধার্থে মূল ভবনের সাথে যুক্ত হয় আরো অনেক অংশ, কাল ব্যবধানে যা আজ মহাকরণের রূপ নিয়েছে। শুধু তাই নয় অনেক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই রাইটার্স বিল্ডিং। ১৯৩০ সালে ৮ নভেম্বর বিনয়-বাদল-দীনেশের সেই দুঃসাহসিক ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ যা এখানেই সংঘটিত হয়েছিল, চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে লেখা থাকবে। এরপর ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এই রাইটার্সের বাংলা নাম দেওয়া হয় মহাকরণ। কারণ তখন এটি বাংলার রাজ্য সরকারের মুখ্য সচিবালয় পরিণত হয়। স্বাধীনতার আগে এবং পরে, কখনও লালের আকাশ কখনো বা সবুজ বাতাস। রাইটার্স দেখেছে বহু অত্যাচার, বহু দুর্নীতি। হেস্টিংসের স্বপ্নের লালবাড়ি আজ আহত, ধুঁকছে বাঙালির নস্টালজিয়া। তবুও তো দুই শতাব্দীর খন্ড ইতিহাস কাঁধে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে বাংলার গর্ব , ইতিহাসের দূত রাইটার্স বিল্ডিং।
Discussion about this post