একটা বিষয় খেয়াল করেছেন কি? এই যে জুন মাস, তার শেষে যেমন বিশ্ব সঙ্গীত দিবস, তেমনি তার গোড়ায় ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। গোড়ায় গলদ আর কাকে বলে! যা নিয়ে আমরা কেউ মোটেই চিন্তিত নই, অর্থাৎ পরিবেশ। তাকে নিয়ে যদি মাসের শুরু হয়, তবে বলাই বাহুল্য বাকি বিষয়গুলি নিয়েও মোটেই চিন্তা থাকবে না আমাদের। আপনি একটু সন্দিগ্ধ হলেন নিশ্চয়ই। এত লক্ষ লক্ষ গান বেরোচ্ছে রোজ, তার এত এত ভিউ, বড় শিল্পীদের এত সমাদর, এসব তাহলে হচ্ছে কোথা থেকে! আমরা সঙ্গীত-সচেতন নই, এ একেবারে ডাহা মিথ্যা। আপনি যদি একথা বলেন, তবে এসব স্বীকার করেও আমার সামান্য কিছু বলার আছে। ইতিহাসের কথা। এ দিন-যাপন কে শুরু করলেন, কী উদ্দেশ্যে এসব আর কী!
আমরা মোটামুটি জানি ১৯৮২ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে প্রথম এই দিনটি উদযাপন করা হয়েছিল। উদ্যোক্তা ছিলেন মরিস ফ্লিউরেট। ফ্রান্সের সংস্কৃতিমন্ত্রী জ্যাক ল্যাংও ছিলেন এর পিছনে। ১৯৮১ সালে তাঁরই অনুরোধে ফ্লিউরেট সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধ্যক্ষ হন। ফ্লিউরেটের বয়স তখন ৪৯। এর আগেও তিনি নেশা ও পেশার সূত্রে যেখানে যেখানে ছিলেন, সেইসব জায়গায় অন্যরকম ভাবনার ছাপ রেখে এসেছিলেন। এখানেও তাই ঘটল। প্রথমবার প্যারিসে যখন এই দিন উদযাপন হল, তখন সমস্ত অ্যামেচার মিউজিসিয়ান তাঁদের নিজস্ব সম্বল নিয়ে পথে নামলেন। পথেই আনন্দ করে একসাথে সকলে গান গাইলেন, সাধের যন্ত্রটিকে বাজিয়ে শোনালেন। ট্যাগলাইনই ছিল, “The music everywhere, and the concert nowhere”। আলাদা করে মঞ্চ নয়, বরং আপনি যেখানে আছেন সেখানেই মঞ্চ গড়ে উঠুক— চমৎকার ব্যাপার, তাই না! একবার ভাবুন তো, সারা দেশ, সারা পৃথিবী একসঙ্গে গেয়ে উঠছে! গান গাওয়ার থেকেও বড় কথা, সবাই সবার পাশে থেকে দিনটিকে পালন করছে। মিলেমিশে থাকার এমন একটি দিন তো খুব দরকারি, তাই না!
অথচ, এখন যে আমরা মিলেমিশে নৃত্য-গীত-বাদ্য সহযোগে পাশ্চাত্যের দেখাদেখি একটি দিন পালনের উদ্যোগ নিচ্ছি, দেশের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখলে হয়ত আমার দেশই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারত। প্রাচীন ভারতে যে বসন্তোৎসব/ মদনোৎসব পালন হত, তা কিন্তু কেবল রঙিন হওয়ার উৎসব ছিল না। কাব্য সাহিত্যে এর উল্লেখ কম নয়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সেতু’ মনে পড়ে? “উদ্যানের গাছে গাছে হিন্দোলা দুলিতেছে, গুল্মে গুল্মে চটুলচরণা নাগরিকার মঞ্জীর বাজিতেছে… কঙ্কণ, নূপুর, কেয়ূরের ঝনৎকার, মাদলের নিক্কণ, লাস্য-আবর্তিত নিচোলের বর্ণচ্ছটা, স্খলিত কণ্ঠের হাস্য-বিজড়িত সঙ্গীত…” এসব পরিবেশন কেবল আনন্দের জন্য, নিজে ভালো থাকার জন্য, সকলে মিলে ভালো থাকার জন্য।
কিন্তু এখন! বাজারে টিকে থাকাটাই যখন বড় কথা, কে কাকে ফেলে রেখে কতটা এগোতে পারবে সেটাই যখন প্রধান। সেখানে মানুষ মানুষের পাশে থেকে শুধুমাত্র আনন্দ করে গান গাওয়া বড় বেশি চাওয়া নয় কি! একজন অল্প পরিচিত শিল্পী খুব সহজেই সকলের দৃষ্টি বা শ্রবণের অনেক দূরে চলে যান। শেষ জীবন অবহেলায় কাটানোটাই তাঁর অবধারিত ভাগ্য লিখন, সেখানে এই দিনটি নিয়ে কতটুকু আলাদা ভাবনা ভাবা হবে বলে আপনি মনে করেন? সঙ্গীত দিবসে তাই সেখানে মূলত প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের নিয়ে মঞ্চানুষ্ঠানই হবে। প্রতিটি বিষয়ের মত সঙ্গীতেও ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য’ মুছে দিয়ে কেবল একটি বিশেষ ধরণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আঞ্চলিক সঙ্গীত, লোক সঙ্গীত সমস্তটাই বাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। বাজার যেমন করে চাইবে, বাজারে টিকতে হলে আপনাকে তেমন করে গাইতে হবে। আক্ষেপ শব্দটা তাই বন্ধ আলমারির তাকে তোলাই থাক।
Discussion about this post