বাঙালি মানেই খাদ্যরসিক। পরিপূর্ণ আহার ছাড়া বাঙালির পেট তো নয়ই মনও ভরে না। বাঙালির খাদ্যতালিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস, শীতের সকালের শুক্তো থেকে মাছের ঝোল বা বিভিন্ন তরকারিতে যার আধিপত্য সেটি হল ‘বড়ি’। ‘বড়ি’ শুকনো ডালের তৈরী পুডিং বিশেষ। এটি চালকুমড়ার পেস্ট থেকেও তৈরি করা হয়। আধুনিক খাবারের ভিড়ে এই খাবারের ব্যবহার কমে এলেও আজও এই ‘বড়ি’ই গোটা একটি গ্রাম, গোবিন্দগঞ্জের উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা। গোবিন্দগঞ্জের উজিরপাড়ার বাইগুনী গ্রামের বাসিন্দাদের মূল জীবিকা ‘বড়ি শিল্প’। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেটে গেলে চারিদিকেই চোখে পড়ে নীল জালে সাদা মাষকলাইয়ের বড়া। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চলে মাষকলাইয়ের বড়া বানানোর আয়োজন। শালমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানান, “গ্রামের নারীরাই সাধারণত এগুলো বানান আর পুরুষরা তা হাটে হাটে বিক্রি করেন। বড়া বানিয়েই অনেকে সংসার চালান। গ্রামের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখেন।”
বড়ি শিল্পীদের মতে, অসীম ধৈর্য আর পরিশ্রমের ফল এই বড়ি। মূলত বড়া বানাতে প্রথমে প্রয়োজন হয় মাসকালাইয়ের ডাল। প্রথমে সেটিকে সারারাত জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরদিন সকালে সেগুলোর খোসা ছাড়াতে হয়। তারপর শিলপাটায় বেঁটে ভালো করে গুলতে হয়। এরপর হাতের দক্ষতায় ছোট ছোট গম্বুজ আকৃতি করে জালের ওপর দিয়ে রোদে শুকাতে হয়। ভালো রোদ পেলে দুদিনেই শুকিয়ে যায় বড়ি। রোদে শুকনোর পর সহজেই এটি প্রায় এক বছরের জন্য স্থায়ী হতে পারে।
এই শিল্পের সাথে যুক্ত মহিলারা জানান, “আশ্বিন-কার্তিক মাস থেকে প্রায় ফাল্গুন মাস পর্যন্ত আমরা বড়ি বানাই। ধান মাড়াইয়ের পরপরই শুরু হয় বড়া বানানোর কাজ। প্রতিদিন প্রায় ৩০-৩৫ কেজি বড়া বানাই। বানানোর পর তা গ্রামের হাটে বিক্রি করি। অনেকে বাড়িতে এসেও নিয়ে যান।” সাধারণত বড়ি পাইকারি ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়ে থাকে। বড়ি তৈরীতে আগে শিলপাটায় বাঁটা হত মাষকলাইয়ের ডাল। যাতে ১০ কেজি কালাই বাঁটতেই দুজন লোকের তিন-চার ঘণ্টা লাগতো। এখন ব্লেন্ডারের সাহায্য প্রায় এক ঘণ্টায় ১০-১২ মণ কালাই বাঁটা সম্ভব। তবে স্থানীয়রা জানান, আগে গ্রামে শীতকালে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বড়া বানাতো হতো। তবে জিনিসের দাম বৃদ্ধি ও স্বল্প লাভের কারণে বর্তমানে গ্রামের হাতে কয়েকটি পরিবার এ বড়া বানানোর সঙ্গে যুক্ত আছে। একমাত্র সরকারী সাহায্যই পারে এই শিল্পকে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌছে দিতে।
Discussion about this post