“আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ও গো বিদেশিনী…” – গানের মতোই মনকাড়া ছিল তাঁর উপস্থিতি, তাঁর চোখের চাহনি, গলার ভঙ্গি। তিনি উত্তম কুমার—বাংলার পর্দার চিরসবুজ মহানায়ক। তাঁর জীবন ঘিরে রয়েছে অজস্র গল্প, কিংবদন্তির মতো শোনা যায় যেগুলো। তবে উত্তম কুমারের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্ক এবং তাঁদের যুগলবন্দি ‘নায়ক’ ছবির গল্প একটু আলাদাই। এক সুপারস্টার এবং এক দৃষ্টিশীল পরিচালকের সম্মিলনে তৈরি হয়েছিল এমন এক ছবি, যা সময়কে ছাপিয়ে আজও সমান প্রাসঙ্গিক। আর এই ছবির প্রথম দিনের শ্যুটিংয়েই ঘটে গিয়েছিল এক মজার অথচ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, যা আজও সিনেমাপ্রেমীদের কাছে অমূল্য।
‘নায়ক’-এর শ্যুটিং শুরু হবে, প্রথম দিনের প্রথম শট। পরিচালক জানিয়ে দিলেন—মহানায়ককে মেকআপ ছাড়াই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে। খবরটা যখন উত্তম কুমারের কানে পৌঁছোয়, খানিকটা বিস্মিত হন তিনি। ভাবতেই পারেননি তিনি—বাংলার সুপারস্টার, তাঁর মুখে বসন্তের দাগ এখনও স্পষ্ট, সেই অবস্থায় মেকআপ ছাড়া ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন! কারণ ‘নায়ক’ ছবির শ্যুটিং শুরু হওয়ার কিছুদিন আগেই উত্তম কুমারের বসন্ত রোগ হয়েছিল। ফলে মুখে রয়ে গিয়েছিল কিছু দাগ, যা তিনি পর্দায় দেখতে চাইতেন না। বিষয়টি তাঁকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
তিনি ভাবলেন, হয়তো পরিচালককে বোঝানো যাবে—মেকআপ ছাড়া শ্যুটিং ঠিক হবে না। কিন্তু পরিচালক ছিলেন অনড়। তিনি বললেন, একবার শ্যুট করে দেখা হোক। যদি অভিনেতা নিজে পছন্দ না করেন, তাহলে মেকআপ করে ফের শ্যুট হবে। অবশেষে উত্তম কুমার রাজি হলেন। ক্যামেরা চলল। শ্যুট শেষ হওয়ার পর যখন সেই দৃশ্য তাঁকে দেখানো হল, তিনি অবাক হয়ে যান। আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন তিনি। নিজেই বলেছিলেন, “এ তো অসাধারণ লাগছে! তাহলে এতদিন মেকআপ করে যা করতাম, সবই বৃথা!” সেই মুহূর্তেই তিনি বুঝেছিলেন, কেবল আলো, ক্যামেরা আর একজন দক্ষ পরিচালকের মুঠিতে পড়েই কীভাবে বাস্তবতাকে রূপান্তর করা যায় পর্দার জাদুতে।
যে দৃশ্যটি তাঁকে আপ্লুত করেছিল, সেটিই পরে হয়ে ওঠে ‘নায়ক’ ছবির অন্যতম আইকনিক মুহূর্ত—যেখানে টেলিফোন হাতে উত্তম কুমার কথা বলছেন এক বিষণ্ণ অথচ বর্ণময় অভ্যন্তরজগৎ থেকে। শ্যুটিংয়ের সেই প্রথম দিনের দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার পর ‘নায়ক’ ছবির পুরোটা সময় জুড়েই আর কখনও মেকআপ নিয়ে কোনও আপত্তি করেননি মহানায়ক। বরং ক্যামেরার সামনে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছিলেন পরিচালকের কাছে। আর তাতেই সৃষ্টি হয়েছিল এমন এক শিল্পকর্ম, যা আজও বাঙালির মনে অমলিন।
চিত্র ঋণ – অমিতাভ দাশগুপ্ত
Discussion about this post