পুজো বাকি আর হাতে গোনা কয়েকদিন। পাল মশাইয়ের হাতে সময় এক্কেবারে বাঁধা। কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতী নিয়ে মা দুর্গার খড়ের কাঠামো প্রায় শেষের দিকে। শুধু মাটির প্রলেপের অপেক্ষা। রাত্রে এ পর্যন্ত কাজ শেষ করে পাল মশাই গেলেন ঘুমোতে। কিন্তু সকালে উঠে দেখেন এ কি কান্ড! কার্তিক যে ডানদিকে সরে গেছে,আর গণেশ বাঁ দিকে! সঙ্গে সঙ্গে জায়গা পরিবর্তন করে দেন পালমশাই। সেরে ফেলা হল বাকি কাজ। কিন্তু পরদিন সকালেও যেই কি সেই! সঙ্গে সঙ্গে গৃহকর্তা বনমালী সাহা রায় নির্দেশ দেন নতুন করে আবার শুরু করা হোক প্রতিমা তৈরীর কাজ। কিন্তু গৃহকর্ত্রী জানান, দেবীর এটিই ইচ্ছে। তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন এমন করেই তাঁদের কাছে পুজো নিতে চান মহামায়া। সেই থেকেই সাহা বাড়িতে গণেশের অবস্থান মায়ের বাঁদিকে আর কার্তিকের অবস্থান মায়ের ডানদিকে। এমনভাবেই মা দুর্গার পূজো হয়ে আসছে তাঁদের বাড়িতে ১৮৪০ সাল থেকে।
বর্তমান উত্তরসূরি রামকৃষ্ণ সাহা রায় জানান,প্রায় ১৮১ বছরের সাহা বাড়ির পুজোর সূচনা বনমালী সাহা রায়ের আমলে। সে সময়ে তাঁদের বাসস্থান ছিল পূর্ববাংলার পাবনা জেলার জামিত্তা গ্রামে। তাঁদের মূল পদবী সাহা। জমিদারী সূত্রে ‘রায়’ উপাধি পাওয়া।দেশ ভাগের বহু আগেই জলপথে ব্যবসার খাতিরে বালুরঘাটে পাড়ি। ব্যস সেই থেকেই বালুরঘাটের বাসিন্দা। বালুরঘাটের ঐতিহ্যময় পুরোনো পুজো গুলির মধ্যে সাহা বাড়ির পুজোকে ধরতেই হবে। ওপার বাংলার পাশাপাশি এপার বাংলাতেও চলতে থাকে পুজো। ওপারে পুজো সামলাতেন রামকৃষ্ণবাবুর ঠাকুমা কুমুদিনী দেবী।
আরও পড়ুন সাবেকিয়ানায় ভরপুর ইসলামপুরের এই দুর্গা কাঠামো তৈরি মুসলিমের হাতে!
তবে পদ্মায় জল গড়িয়েছে অনেক। ওপার বাংলার অনেক সদস্যই এসেছেন এপারে। বর্তমানে তাঁরা বালুরঘাটের সাড়ে তিন নং মোড়ের বাসিন্দা। সময়ের স্রোত এতটা বয়ে গেলেও পুজো বন্ধ হয়নি কোনোপারেই। পুজোয় এখনো স্বমহিমায় বজিয়ে রাখা হয়েছে সাবেকিয়ানা। উমার খাতির যত্নে রাখা হয়না কোনো ত্রুটি। তবে এখানে অন্নভোগ দেওয়া হয়না। পরিবর্তে মিষ্টান্ন ভোগ। শুধু বাড়ির সদস্যরাই নয়,সাহা বাড়ির পুজোয় অংশগ্রহণ করেন বাইরের অনেক লোকজন। অষ্টমীর অঞ্জলী থেকে দশমীর সিঁদুর খেলা। সাহা বাড়ির দরজা পুজোর সময় খোলা বাইরের দর্শনার্থীদের জন্য। তবে কো-১৯ এর দাপটে গত বছর চাপানো হয়েছিল কিছু বিধিনিষেধ। মায়ের ভোগ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল গোটা ফলমূল। তবে বাইরের দর্শনার্থীদের মধ্যেও বিলি করা হয় পুজোর প্রসাদ।
আরও পড়ুন মা দুর্গা এখানে রক্তবর্ণা বড়দেবী! ময়না কাঠেই পুজো পান মহামায়া
মহাধুমধাম করে পুজো অবশেষে শেষ দশমীতে। দুগ্গা মায়ের এবার শিবের কাছে ফেরা। তাই দশমীতে থাকে মায়ের বিশেষ ভোগ। সাধারণতঃ মাছ সহযোগে পান্তা ভাত দেওয়ার রীতি অন্যান্য জায়গায় প্রচলিত থাকলেও, সাহা বাড়িতে দেওয়া হয় ভ্যাটের খই আর দই, শালুক ফলের টক। সবশেষে মায়ের কৈলাস যাত্রা শুরু। আবার একটি বছরের অপেক্ষা। স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকুক সাহা বাড়ির মতো সাবেক পুজো। ততদিন না হয় বলা যাক, “আসছে বছর,আবার হবে।”
Discussion about this post