রোববারের দুপুর, তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত আর গরম গরম এক বাটি মাংস। যেন একেবারে রাজযোটক। বাঙালি বাড়ির এই রান্না, ওই সব চাইনিজ-ইতালিয়ান রান্নাকে একেবারে শূন্য গোলে হারিয়ে দেবে। সাধে কি আর একে ‘বাংলার বাসমতি’ বলা হয়! তুলাইপাঞ্জি চাল এর চাহিদা কিন্তু শুধু বাংলায় নয়, বাইরের দেশের মাটিতে ও চাহিদা অনেক। কিন্তু এই ভ্যারাইটি জাতে একেবারে খাঁটি বাঙালি! বাংলার মাটি ছাড়া অন্য কোথাও চাষ করলে তার গুণ সেভাবে ফুটে ওঠে না। তাও যদি হয় মোহিনীগঞ্জের তুলাইপাঞ্জি, ব্যাস তাহলে “দই পুরো জমে ক্ষীর।”
প্রতিবছর জুন-জুলাই মাসে খারিফ ফসল হিসেবে লাগানো হয় তুলাইপাঞ্জি ভ্যারাইটিকে। ফসল কাটা হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে। সূর্যের আলোতে ভীষণভাবে সংবেদনশীল, এই ধান চাষে কিন্তু কোনোরকম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। তাতে চালের সুগন্ধ কমে যায় অনেকটা। পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় জৈব সার। জমি থেকে পাট তোলার পরই কৃষক বন্ধুরা এই ধান লাগায় জমিতে। আগস্টের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই নার্সারি জমি থেকে মূল জমিতে চারাগাছ রোপণ করা হয়। অন্য জাতের ধানের মত এ ধানের বিশেষ কোনো ঝামেলার প্রয়োজন নেই। আর এই জন্যই তো তুলাইপাঞ্জি সকলের এত প্রিয়।
এই ধান বিশেষ করে চাষ করা হয় বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলে। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ, ইটাহার ,কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ, দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট, চিঙ্গিশপুর,আমরাইল এলাকায় এই ধান ভালো চাষ হয়।মনে করা হয় এই এলাকার মাটি তুলাইপাঞ্জি ধান চাষের পক্ষে বেশি উপযুক্ত। তাই এই এলাকায় ফলানো ধানের সুগন্ধ যেন আরেকটু বেশি। এই চাল কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তরফ থেকে ২০১২ সালে খাদ্য উৎসব এও লন্ডন অলিম্পিকে গিয়েছিল!
খিচুড়ি হোক কিংবা পায়েস, মাঝারি আকৃতির তুলাইপাঞ্জির ধারেপাশে কেউ আসবে না। একসময় কোন বাড়িতে এ চালের ভাত রান্না করলে ছড়িয়ে পড়তো আশপাশের দশটা বাড়ি পর্যন্ত। কি জিভে জল এল তো? আসাটাই স্বাভাবিক। তবে দিনাজপুরের লোকেরা এ চালটিকে কিন্তু একটু অন্যরকম ভাবেই রাঁধতে পছন্দ করে। এই চালের ভাত রাঁধতে হবে হাঁড়িতে। রাইস কুকার বা প্রেসার কুকারে একেবারেই নয়। হাঁড়িতে চাল দেওয়ার আগে, তা ঠান্ডা জলে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে আরো ভালো। তারপর, হাঁড়ির জল ফুটতে শুরু করলে চাল দিয়ে দিতে হবে । চাল সেদ্ধ হতে সময় নেয় খুবই অল্প। ৭ থেকে ৮ মিনিটেই সুসিদ্ধ রূপে হাজির তুলাইপাঞ্জি। ভাতের মাড় ছাঁকতে হবে একেবারে নিপুণভাবে।হাঁড়ির ঢাকনা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একেবারেই খোলা চলবে না। কিছুক্ষণ বন্ধ রাখা প্রয়োজন। ব্যাস যে কোন তরকারির সাথে পরিবেশন করুন তুলাইপাঞ্জি চালের সাদা ঝরঝরে ভাত।
তবে সমস্যা একটিই। বাজারে ঠিকমতো দাম না মেলায় , চাষিরা এই ধান চাষে বিশেষ আগ্রহ দেখান না। বাসমতি চালের মতও এর নেই কোনো ব্র্যান্ড ট্যাগ ও। উপরন্তু ব্যবসায়ীরা আসল তুলাইপাঞ্জি চাল এর সাথে মিশিয়ে দেয় অন্য জাতের চাল। তাতে তুলাইপাঞ্জির আসল গুণগত মান কমে যায় কয়েক ধাপ। কিন্তু বিশ্বস্ত দোকানে খোঁজ করলে এখনো পাওয়া যাবে আসল জাতের চাল। দোকানে পা রাখতেই , নাকে আসবে এক তীব্র মিষ্টি সুগন্ধ। আর কেউ যদি হয়ে থাকে পাকা খদ্দের, গোয়েন্দা চোখে বুঝে নেবে ওটি তুলাইপাঞ্জিই।স্বদেশীয় এই ভ্যারাইটি দামেও একেবারে মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে। বাজারে এর দাম ৮০-৯০ টাকা/কেজি। তাহলে আর দেরি কেন? এখনই তো সময়। এই ভরা বর্ষায় একদিন পাতে পড়ুক তুলাইপাঞ্জির ভাত!
Discussion about this post