‘পাসওয়ার্ড!’ বাবার হাত ধরে থমকে দাঁড়ালা! কী হবে এখন? আমি চেঁচিয়ে বললাম ‘ফুল’। “চলো দোস্ত সব ঠিক হ্যায়।” ছোট্ট বুকে তখন বাঁচার আশা, হ্যাঁ পাকিস্তান-ভারত সীমানায় তখন এই নিয়ম। একেকটি ভারতীয় রেজিমেন্ট তাদের সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশের জন্য এই ব্যবস্থাই রেখেছিল। আতঙ্ক আর উত্তেজনায় ভরা প্রতিদিনের সন্ধ্যা। জম্বুর অনতিদূরে রাজৌরি। ভারত পাকিস্তানের সীমান্তে রাজৌরিকে একটি গ্রামই বলা যায়। সেখানে বসবাসের জন্য সাদামাঠা অতিসাধারণ অস্থায়ী সব ঘরবাড়ি। রাজৌরির মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে একটি হিমশীতল জলের ক্যানেল। পাকা সড়ক তারই গা ঘেঁষে। সালটা সম্ভবতঃ ১৯৫৮। আমি খুব ছোট হলেও মনের সেই টুকরো স্মৃতিগুলো আজও হারিয়ে যায়নি মন থেকে। বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর এক সামরিক আধিকারিক। আমার ছোট থেকে বড় হওয়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে। সে সময় তিন-চার বছরের শিশুদের স্কুলে পাঠানোর রেওয়াজ ছিল না। একটু দেরিতেই আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচয়।
রাজৌরিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত এলাকায় তখন আমরা থাকতাম। কাদা মাটি দিয়ে ইটে গাঁথনির বাংলো। বাড়ির পিছনে আমার প্রথম দেখা সুদূরপ্রসারী ধানক্ষেত। সেদিকে চোখ মেললে দেখা যায় ভারত-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ রেখায় পতপত করে উড়ছে দু’দেশের জাতীয় পতাকা। বাবার দায়িত্বপূর্ণ কাজ সেনাবাহিনীতে, বিকেলে বাবার হাত ধরে বেড়াতে যাওয়া, চিন্তা শুধু একটাই! আজকের পাসওয়ার্ড জানা আছে তো? প্রতিদিনই নিত্য নতুন পাসওয়ার্ডের ব্যবস্থা ছিল। এক সংরক্ষিত এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে প্রতিদিনই পাসওয়ার্ডের প্রয়োজন হয়। ব্যাপারটা ছিল খুবই গোপনীয়।সীমান্তবর্তী এলাকায় এই সতর্কতার অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। এলাকার প্রবেশ পথে, বন্দুক ধারী সৈন্য সর্বক্ষণ অতন্দ্র প্রহরায় নিযুক্ত থাকত। বিকেলের পর সতর্কতা বেড়ে যেত। কোন আগন্তুকের উপস্থিতিতে বন্দুক তুলে পাসওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করা তাদের রোজ দিনের কর্তব্য ছিল। ‘ফুল’, ‘নদী’,’পাথ্থর’ এই ধরনের পাসওয়ার্ডের প্রচলন ছিল। আমরা কয়েকটা মাস এই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। শহরের কোলাহল মুক্ত অন্য এক জগৎ। অসহ্য গরমের পর এল বর্ষা। জল থৈ থৈ পরিস্থিতি চারিদিকে। সামরিক বাহিনীর গাড়ি করে নিত্য দিন জল দিয়ে যাওয়া। মা’র কোলে বড় হওয়া বোনকে নিয়ে কিছুটা সময় কেটে গিয়েছে।
রুক্ষ প্রকৃতিই রাজৌরির সৌন্দর্য্য। খাঁটি গরু মোষের দুধ আর চাষবাস ছিল গ্রামবাসীদের জীবিকা। মাঝে মধ্যে হেঁটে বাবার সাথে সহকর্মীদের বাড়ি যাওয়া। আবার প্রতি মাসে সামরিক বাহিনীর বড় গাড়িতে করে কয়েকটি পরিবার মিলে প্রয়জনীয় জিনিসপত্র কিনতে জম্বুতে যাওয়া। এভাবে কয়েকটা মাস কেটেছে সেখানে। মনে পড়ে পাসওয়ার্ড ভুল হবার ভয়ে বাবার বন্ধুর বাড়ি গিয়ে রাতে বাড়ি না ফেরা। পাসওয়ার্ড না বলতে পারলে সৈন্যদের আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমা আমাকে ভীত করে তুলত। ওদের সামনে দাঁড়ালে বুকের হৃদস্পন্দন সেই ছোট্ট বয়সেও স্পষ্ট শুনতে পেতাম।
জীবনের সায়াহ্নে এসে ফেলে আসা দিনগুলো মনে আসা যাওয়া করে। স্মৃতিগুলি মনে এনে দেয় এক অপূর্ব অনুভূতি এবং অনাবিল আনন্দ। স্মৃতির মণিকোঠায় বারবার উঁকি দেয় সেই ভয় ও সুখ মাখা দিনগুলির এক সুন্দর অনুভূতি।
Discussion about this post