নগরের থাবা চারিদিকে পড়লেও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও বাঁচে গ্রাম বাংলায়। তেমনি ঐতিহ্যবাহী এক মন্দির হল দোগাছির রাজবল্লভীর মন্দির। এ মন্দির নদিয়ার এক দৃষ্টান্ত বটে! শোনা যায়, সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি রাজবল্লভী নামে জনৈক জেলের জালে দোগাছির বিল থেকে ওঠে পাথরের তৈরি এক দশভুজা মূর্তি। আবার পরে জালে ওঠে এক বিষ্ণুমূর্তি। তৎক্ষণাৎ খবর যায় নাটোরের জমিদার রাণী ভবানীর কাছে।
তিনি গ্রামে পোড়ামাটির কারুকার্য করা সুন্দর দোচালা মন্দিরটি তৈরি করান। সেই সঙ্গে মূর্তি দুটি প্রতিষ্ঠা করেন। নিত্য সেবার জন্য দেবোত্তর সম্পত্তির ব্যবস্থা করেন। রাজবল্লভ নামের ব্যক্তি দুর্গামূর্তিটি বিল থেকে উদ্ধার করেন, তাই দুর্গা মায়ের নাম হয়েছে রাজবল্লভী। বাংলা ১৩০৪ সালে মন্দিরটি ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে সেই ভূমির উপর তৈরি হয়েছে পঞ্চরত্ন মন্দির। এ মন্দির এলাকার হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের সেবায় জীবিত হয়ে ওঠে বারবার।
মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত তিনফুট লম্বা ও দেড় ফুট দশভুজা মূর্তিটি দুষ্প্রাপ্য কালো কষ্টিপাথরের। মহিষাসুর, সিংহ ও মহিষ রয়েছে। দুপাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী। এই মূর্তিগুলির নিচে গণেশ ও কার্তিক। সিংহটি অনেকটা ঘোড়ার মতো। পদ্মের উপর দণ্ডায়মান ত্রিবিক্রম বিষ্ণু মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় আড়াই ফুট, চওড়া প্রায় এক ফুট। তার উপরের ডান হাতে দণ্ড বাম হাতে চক্র এবং নিচের ডান হাতে পদ্ম বাম হাতে শঙ্খ। দ্বিভঙ্গ ভঙ্গিতে ডান পাশে লক্ষ্মী আর বাম পাশে সরস্বতী। তাঁদের পাশে চক্র পুরুষ ও শঙ্খ পুরুষ। উপরের দিকে চালির দু’পাশে বিদ্যাধর বিদ্যাধরী উড়ন্ত অবস্থায় মালা হাতে।
১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর এক দুর্যোগপূর্ণ ঝড়বৃষ্টির রাতে দুর্গামূর্তিটি চুরি যায়। মূর্তি উদ্ধারে এলাকার বাসিন্দারা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তৎপর হয়ে ওঠেন। সেই সময় বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। তাই বাংলাদেশে মূর্তিটি যাতে পাচার না হয়ে যায় তারজন্য দিল্লির মন্ত্রীমহলে ও রাষ্ট্রপতিকে জানানো হয়। বেশ কয়েকদিন পর গ্রামবাসী ও প্রশাসনিক তৎপরতায় গ্রামের প্রান্তে এক বাঁশঝাড়ের মধ্যে থেকে মূর্তিটি উদ্ধার করা হয়। শোনা যায়, ডাকাতের দল কোনো এক অলৌকিক কারণে উপায়ান্তর না দেখে মূর্তিটি ফেলে পালিয়ে যায়। প্রায় ২০০ বছর আগে এক সদানন্দ সাধু এই মন্দির আঙিনায় এক পবিত্র কুয়ো খনন করেন। এখনও মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই কুয়োর পবিত্র জল ভক্তিভরে গ্রহণ করেন। মন্দিরে নিত্যসেবা ছাড়াও শারদীয়ায় বাৎসরিক পুজো হয়। পঞ্চমীতে মেলা বসে। মানুষের বিশ্বাস দেবী রাজবল্লভী ভীষণ জাগ্রত। বহু পুরনো এ মন্দির মানুষের মনে আজও বিশ্বাস হয়ে জেগে আছে।
চিত্র ঋণ – বঙ্গদর্শন
Discussion about this post