তিলোত্তমার ঠিক পাশেই নানান ঐতিহ্যে পুষ্ট বহুল পরিচিত শহর হাওড়া। এই শহরের আনাচে কানাচে যেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান অজানা কাহিনী, ঠিক তেমন বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানান ঐতিহ্য। তেমনই এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প হল হাওড়ার নিজস্ব পুতুলশিল্প, যা কিনা আজও গুটিকয়েক হাতের জাদুতে মন ভোলাচ্ছে সাধারণ মানুষের। হাওড়া- আমতা লাইনে অবস্থিত জগৎবল্লভপুর থানার অন্তর্গত নরেন্দ্রপুর গ্রাম। আজও পরিচিত মৃৎশিল্পীদের গ্রাম হিসেবে। একসময় এখানকার পুতুল শিল্প খ্যাতির শিখরে থাকলেও এখন হয়তো তা কালের নিয়মে ধুঁকছে!
হাওড়ায় যারা থাকেন তারা অনেকেই জানেন একসময় এই শহরের খ্যাতি ছিল রানি পুতুল, টেপা পুতুল, মাটির নৌকা আর পালকি–এসব মৃৎশিল্প তৈরির কারণে। কারণ এই সৃষ্টিগুলি শহরের একেবারে নিজস্ব। মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে সম্বল করেই তার সৃষ্টিসুখে মশগুল হয়ে উঠতেন। একসময় শুরু হয় নিজের অবয়বকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা।গ্রামীণ হাওড়ার জগৎবল্লভপুর,পাঁতিহাল,নরেন্দ্রপুর সহ বিভিন্ন গ্রামে এককালে প্রচুর তৈরি হত এইসব পুতুল।
নরেন্দ্রপুর গ্রামের রানি পুতুল থেকে শুরু করে পাঁতিহাল টেপা পুতুল–প্রত্যেকটি সৃষ্টির সঙ্গে মিশে আছে বাংলার মানুষের সূক্ষ্ম ভাবনা,মান এবং ঐতিহ্য। রানি পুতুলের ইতিহাস নিয়ে অনেকের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন রকমের মত। পোড়ামাটির এই বিশেষ পুতুলটিকে গোলাপি রঙ করে তাতে অভ্র মেশানো হয়। মাথাজুড়ে কোঁকড়ানো চুল। তবে থাকে না কোনও পা। কোমর থেকে দেহের বাকি অংশ ঘাগড়ায় ঢাকা। কখনও কখনও আরও সুন্দর করে তুলতে মুকুটও পরানো হয়। গ্রামের কয়েকজন শিল্পীর হাতের গুণেই আজও বেঁচে আছে হাওড়া জেলার এই লোকশিল্প রানি পুতুল। এছাড়া পাঁতিহাল গ্রামের কুমোররা তৈরি করেন ছোটো ছোটো অসম্পূর্ণ হাত ও পা-হীন টেপা পুতুল।
হ্যাঁ, আজ নতুনত্ব শৌখিন সব নামীদামী পুতুলের ভিড়ে গ্রামবাংলার হাতে গড়া এই সৃষ্টি যথেষ্ট অবহেলিত। তবে গ্রামের মেয়ে-বৌদের চাহিদার মধ্যে আজও বেঁচে রয়েছে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এই লোকশিল্প। ছোটো ছোটো মেয়েদের বায়না ও আবদার মেটাতে মায়েরা আজও রানি পুতুল, টেপা পুতুল কিনে দেন। এছাড়াও রয়েছেন শহুরে কিছু মানুষজন যারা ধ্বংসপ্রায় এইসব শিল্পগুলোকে সংগ্রহ করে শিল্পীদের কায়িক পরিশ্রমের মর্যাদা দেন। তাদের হাত ধরেই আজও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে গ্রামবাংলার পুতুলের ঐতিহ্য।
Discussion about this post