প্রাচীন ভারতীয় বণিকেরা, বিশেষ করে মালাবারের (কেরালা) ব্যবসায়ীরা, ইন্দোনেশিয়া থেকে মশলা সংগ্রহ করতেন এবং তা ভারতীয় রাজাদের কাছে সরবরাহ করতেন। একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে, যে মালাবারের এই বণিকরা এতটাই চতুর ছিলেন, যে তাঁরা মশলার আসল উৎস গোপন রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশল করতেন, যাতে কেউ সেই উৎস সম্পর্কে জানতে না পারে। তার মধ্যেই সম্ভবত ছিল জয়িত্রী ও জায়ফল।
এই দুটি মশলার উৎপত্তিস্থল ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপপুঞ্জ। আরব বণিকরা ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে ভারতীয় উপকূলে এসে মশলা বাণিজ্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। তখন থেকেই জয়িত্রী, জায়ফল ভারতে আসে। পনেরোশ শতকে ইউরোপের আগমনের পর মশলা বাণিজ্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। পর্তুগিজরা বান্দা দ্বীপ থেকে জয়িত্রী ও জায়ফল সংগ্রহ করে ভারতের গোয়া, কোচি এবং কালিকটে নিয়ে আসে। পরে ডাচরা বান্দা দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং মশলা বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে।
একটি ফল থেকেই দুটি সুগন্ধি মশলা! জয়িত্রী (Mace), অন্যটি জায়ফল (Nutmeg)। Myristica fragrans নামের গাছ থেকে এই দুটি মশলা তৈরি। দেখতে অনেকটা আমলকির মতো। পাকলে ভেতরে হয় কঠিন বাদামি বীজ। বীজটিই জায়ফল। বীজের চারপাশে লালচে-কমলা রঙের পাতলা আবরণ, যা শুকিয়ে হয় জয়িত্রী। দুটির স্বাদ ও ব্যবহারে বিস্তর পার্থক্য। জয়িত্রী লাগে বিরিয়ানি, মাংসের রেজালা, সুপ এবং বিভিন্ন ধরনের বেকড খাবারে। স্বাদ কিছুটা মিষ্টি ও হালকা ঝাঁঝালো। জায়ফল দুধ, মিষ্টি, কফি ও চায়ে দেওয়া হয়। এর স্বাদ উষ্ণ এবং ঝাঁজালো, খুব সামান্য দিলেই যথেষ্ট। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে জয়িত্রী হজমশক্তি বৃদ্ধির, ব্যথা উপশমে সাহায্য করে, আর জায়ফল ঘুম আনতে সহায়ক।
জয়ত্রী ও জায়ফল এক সময় এত মূল্যবান ছিল, যে এই মশলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। পনেরোশ থেকে ষোলোশ শতকে বিশেষত ডাচ, ব্রিটিশ ও পর্তুগিজদের মধ্যে এই মশলার বাজার দখলের প্রতিযোগিতা ছিল। এক পাউন্ড জায়ফলের মূল্য ছিল এক পাউন্ড সোনার সমান। আজ এই দুই ফল আর বিলাসবস্তুর তালিকায় নেই। এসব এখন সারা বিশ্বেই সহজলভ্য। রান্নাঘরে থাকা এই দুটি মশলা শুধু খাবারের স্বাদই বাড়ায় না বরং বহুকাল ধরে তা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।
Discussion about this post