বাঙালি ভোজে পোলাও থাকবে না, সেটা যেন ভাবনারও অতীত। বাঙালির ভোজপার্বনের ইতিহাসে পোলাও এক অপরিহার্য উপাদান। এই খাবারটির প্রতি বাঙালির টান যে কতখানি, তা নতুন করে বলে দেওয়ার দরকার পড়েনা। বাংলার পুরনো দিনের গল্পগাছা থেকে শুরু করে, বাঙালি রসনার ইতিহাস, সব জায়গাতেই মুকুটবিহীন সম্রাট এই পোলাও। আর তার সঙ্গে যদি মাংস বা কালিয়ার অনুপান মেলে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। পোলাওয়ের ভালো নাম কিন্তু পলান্ন, অর্থাৎ, পল বা মাংস মিশ্রিত অন্ন। মানে বুঝতেই পারছেন, আজকের দিনে শুভ অনুষ্ঠানে যতই নিরামিষ বাসন্তী পোলাওয়ের চল থাকুক না কেনো, এই পোলাও কিন্তু আদতে ছিল এক নির্ভেজাল আমিষ পদ।
উৎপত্তির সময় অন্যরকম থাকলেও, কালক্রমে অনেকটাই রূপ পরিবর্তন হয়েছে এই খাবারটির। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলার রসনাতৃপ্তির একটা বিরাট দায়ভার নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছে এই পোলাও। তবে, পোলাও যতই বাঙালির প্রিয় খাদ্য হোক না কেনো, এই খাবার কিন্তু আদতে বাংলার নয়। এমনকি ভারতেও এই খাবারের জন্ম হয়নি। সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিভিন্ন সম্রাটদের হাত ধরে ভারতে আসে এই সুখাদ্যটি। চলুন আজকে পোলাওয়ের ভারতাগমনের গল্পই আপনাদের শোনাই।
পলান্ন শব্দটি আদতে একটি সংস্কৃত শব্দ। ফলে, অনেকেই মনে করেন, ভারতবর্ষেই এই খাবারের উৎপত্তি। তবে, পোলাওয়ের ইতিহাসটা এমনটা নয়। অনেকে বলেন, বিশ্বের প্রথম পোলাও নাকি রান্না হয়েছিল সম্রাট আলেকজান্ডারের জন্য। এশিয়া জয় করতে এসে পারস্যের তৎকালীন রাজকুমারী রোকসানার সঙ্গে যখন তার বিবাহ হয়, সেই সময় তার আদর-আপ্যায়নের জন্য বানানো হয়েছিল পোলাও। অনেকে আবার বলেন, সমরখন্দ জয় করে সেখানকার বাসিন্দাদের খুশি করার জন্যই আলেকজান্ডার পোলাও রান্নার বিধান দিয়েছিলেন। আর সেখানকার স্থানীয় পাচকেরা রান্না করেছিলেন বিশ্বের প্রথম পোলাও।
ইতিহাসবিদরা বলেন, এই পোলাও শব্দটি প্রথমবার ব্যবহার করেছিলেন পারস্য বা আরবের মানুষেরই। মনে করা হয়, উজবেকিস্তানের এক পন্ডিত আবু আলী হোসেন ইবনে সিনা প্রথমবার পোলাওয়ের রন্ধনপ্রণালী লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তবে ইতিহাসটা যেরকমই হোক না কেন, ভারতবর্ষে আসামাত্রই ভারতীয়দের রন্ধনশিল্পে একেবারে জাঁকিয়ে বসেছিল এই সুখাদ্যটি। বিশেষ করে নবাবী আমলে নানা রঙে পোলাওকে সাজিয়ে তুলেছিলেন নবাবদের পাচকেরা। সেই আমলে আবির্ভূত হওয়া সব থেকে বিখ্যাত পোলাওয়ের মধ্যে রয়েছে নবরত্ন পোলাও। নবরত্ন পাথরের মতো নয় রঙের চাল মিশিয়ে তৈরি করা হতো এই পোলাও। দামি জহরতের মতো সাজানো সেই পোলাও দেখামাত্রই যেনো ভিরমি খেতেন অতিথিরা। এভাবেই ধীরে ধীরে আবির্ভাব হয় বিভিন্ন রকমের পোলাওয়ের। আর নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে ধীরে ধীরে পোলাওকে নিজস্ব করে নেয় গোটা ভারতবর্ষ।
Discussion about this post