থানা মানেই সেখানে চোর পুলিশের খেলা। আবার কথায় আছে ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’। তাই লোকজন থানা পুলিশ এসবের থেকে একটু তফাৎ রাখতেই পছন্দ করে। কিন্তু এ এক অবাক কান্ড! থানার দেওয়ালে আঁকা আমাদের প্রিয় তিলোত্তমার পরতে পরতে মিশে থাকা নানান ইতিহাসের আঁকিবুকি। অনেকের কাছেই অজানা এই থানার হদিশ। উত্তর কলকাতার সব পুরনো থানাগুলির মধ্যে অন্যতম এই থানাটি হল বড়তলা থানা।
১৮৮৮ ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই পুলিশ স্টেশন। ১ নম্বর রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটে কলকাতা পুলিশের এই থানা বেশ অনেকটাই রূপ নিয়েছে যেকোনো নামিদামি আর্ট মিউজিয়ামের, যা না দেখলে সত্যিই অবিশ্বাস্য। থানার প্রতি আমজনতার মনোভাব বদলাতেই এমন অসাধারণ পরিকল্পনা করেছিলেন বড়তলা থানার ওসি দেবাশিস দত্ত। লালবাজার থানারও ভূমিকা রয়েছে। এই পরিকল্পনাকে রূপদান করেছেন সৌরভ ভট্টাচাৰ্য সহ আর্ট কলেজের তিন ছাত্র। চলুন জেনে নেওয়া যাক কোন কোন ইতিহাসের সাক্ষী বয়ে নিয়ে চলেছে এই বড় তলা থানা।
থানায় ঢোকার পথেই চোখে পড়বে নাট্যকার গিরীশ ঘোষ ও গীতিকার রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ছবি। আজ থেকে একশো বছর আগের কলকাতার চিত্র কেমন ছিল তা যেন থানার প্রতিটি দেওয়ালে জীবন্ত হয়ে উঠেছে রং তুলির টানে। থানায় ঢুকতে প্রহরী যেখানে দাঁড়ান সেখানে স্বাধীনতার আগে কোম্পানির আমলে কেমন ছিল পুলিশের উর্দি, স্বাধীনতার পর এবং বর্তমানে কেমন হলো পুলিশের উর্দি সেই চিত্র ফুটে উঠেছে। লকআপের পাশের দেওয়ালে আঁকা বিরাট এক বটগাছের ছবি। কোথাও পালকির ছবি, আবার কোথাও চড়ক মেলার ছবিও দেওয়ালে চমক বাড়িয়েছে। কোথাও পুরনো হাওড়া স্টেশনের ছবি, আবার কোথাও হলুদ ট্যাক্সি, হাতে টানা রিক্সা, মিনার্ভা থিয়েটারের ছবি। এমনকি বড় তলা থানার নামের পিছনে থাকা ইতিহাসও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এক দেওয়ালে। এই থানার ছাদে সেযুগে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলেছিল দুটি ওয়াচ টাওয়ার। সেই টাওয়ার দুটি আজও সেখানে রয়ে গেছে পুরনো ইতিহাসের দলিল হিসেবে।
বর্তমানে বড়তলা থানার যেটি কনফারেন্স হল, সেই হলের নাম দেওয়া হয়েছে সুতানুটি। এখানেই শেষ নয়, আরেকটি অন্যতম আকর্ষণ হল চিলড্রেন রুম। যেসব শিশুরা নিখোঁজ বা বিপদে পড়ে তাদের উদ্ধার করে এখানেই রাখা হয়। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বই, খেলনা আর দেওয়াল জুড়ে কার্টুন আঁকা। শিশুরা এখানে ভয় বা কান্নাকাটির বদলে সহজেই তিন চার ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় হেসেখেলে। এছাড়া অনেকে রিপোর্ট লেখাতে এসেও দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিয়ে যান। এখানেই স্বার্থক পুলিশকর্তাদের অসাধারণ এই পরিকল্পনা। পুরনো কলকাতার ছবি, তার গৌরবময় ঐতিহ্য, প্রতিটি ইতিহাস পুঙ্খানুুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে এক অসাধারণ নিদর্শন তৈরি করেছে এই বড়তলা থানা।
Discussion about this post