নববর্ষের এক সন্ধ্যায় চারদিক অন্ধকার করে ধেয়ে এসেছিল কালবৈশাখী। রবি ঠাকুর গান ধরলেন, “তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে।” উনিশ শতকে বাংলার সর্বোচ্চ আলোচিত পরিবার নিঃসন্দেহে ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই রান্নাকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এই ঐতিহ্যশালী পরিবার। পয়লা বৈশাখের দিনে খাওয়া দাওয়া হত ঠাকুর বাড়ির দোতলার বারান্দায়। মেঝেতে লম্বা করে কার্পেট বিছিয়ে আলাদা আলাদা মাটির খুরিতে করে পরিবেশিত হত ভিন্ন ভিন্ন পদ। তালিকায় থাকত কাঁচা ইলিশের ঝোল, নারকেল চিংড়ি, চালতা ও চিতল মাছ সহযোগে মুগের ডাল, আম দিয়ে শোল মাছ ইত্যাদি। কবিগুরুর সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীর হাতে তৈরি মানকচুর জিলিপি, দইয়ের মালপোয়া, পাকা আমের মিঠাই, চিঁড়ের পুলি ইত্যাদি ছিল ঠাকুরবাড়ির বিশেষ আকর্ষণীয় পদ।
কবি যে বছর পঞ্চাশে পা দিলেন, সেই বছর পয়লা বৈশাখে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর নিজের হাতে তৈরি বিভিন্ন রান্নার পদ ছিল সেই জন্মদিন উপলক্ষ্যে। পদগুলির নামও ছিল ভারি মজার। যেমন, দ্বারকানাথ ফিরনি পোলাও, রামমোহন দোলমা ভাত, সুরভী পায়েস ইত্যাদি। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল আর এক বিশেষ পদ, যার নাম ছিল ‘কবি সংবর্ধনা বরফি’। শীতশেষের ফুলকপি, খোয়াক্ষীর, বাদাম, কিসমিস, জাফরান আর সোনা-রূপোর তবক দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি যা কবির পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল নিঃসন্দেহে।
রান্না নিয়ে নিত্যনতুন পরীক্ষামূলক চর্চা ছিল ঠাকুরবাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কবি নিজেও নানান রকম নতুন নতুন খাবার খেতে পছন্দ করতেন। নতুন ধরনের বিভিন্ন মিষ্টি ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়। মৃণালিনী দেবীকে রান্নার সময় সরঞ্জাম এগিয়ে দিয়ে সাহায্যও করতেন কবি। মৃণালিনীর তৈরি নববর্ষের জনপ্রিয় মিষ্টি ‘এলোঝেলো’ ছিল কবির খুব প্রিয়। তবে এই নাম তাঁর অপছন্দ হওয়ায় মিষ্টির নামের বদল ঘটিয়ে কবি নতুন নামকরণ করলেন ‘পরিবন্ধ’। উত্তর কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে নববর্ষের খাদ্যতালিকার চমক ভোজনপ্রিয় বাঙালি চিরকাল মনে রাখবে নিঃসন্দেহে।
Discussion about this post