সম্পূর্ণ দিকভ্রান্ত হয়ে নজরুল ছুটলেন তার প্রিয় রবি দাদার শান্তিনিকেতনের বাড়িতে। সঙ্গে নিলেন অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র আর একটা ছোট প্রজেকশন মেশিন। যদিও এই হঠাৎ আগমনের কারণ শুনে বেশ অসন্তুষ্টই হলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কেন? চলুন আজ সেই গল্পই করা যাক।
‘গোরা’ মুক্তি পেতে তখন আর মাত্র দু’দিন বাকি। এই পরিস্থিতিতে গোরার মুক্তি গেল আটকে। ‘গোরা’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক কাজী নজরুল ইসলাম আর সিনেমার প্রযোজক মানু গঙ্গোপাধ্যায়ের তখন দিকভ্রান্ত অবস্থা। তবে কি এতদিনের সব পরিশ্রম বৃথা হয়ে যাবে? জলে চলে যাবে সিনেমার পিছনে খরচা হয়ে যাওয়া সব টাকা? নজরুল বুঝলেন এই অসময়ের পরিত্রাতা যদি কেউ হতে পারেন সে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই ছুটলেন গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে শান্তিনিকেতনে। সঙ্গে নিলেন প্রযোজনা সংস্থা দেবদত্ত ফিল্মসের মালিক মানু গঙ্গোপাধ্যায়কেও। নজরুলের এই হঠাৎ আগমনে রবীন্দ্রনাথ তো বেশ খুশি। তাকে শান্তিনিকেতনে কিছুদিন থেকে যাওয়ার কথাও বললেন তিনি। তা শুনে নজরুল বেশ খুশি হলেও ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথকে জানালেন তাদের হঠাৎ শান্তিনিকেতনে আসার কারণ।
‘গোরা’ মুক্তি পেতে তখন ছিল আর মাত্র দুই দিনের অপেক্ষা। ছবির ট্রেড শোয়ের দিন অন্যান্যদের পাশাপাশি পর্যবেক্ষক হিসেবে হাজির ছিলেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিও। ‘গোরা’ ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের গান। যার সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খোদ কাজী নজরুল ইসলাম। সে সময় রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড কিংবা কোনো ফিল্মে ব্যবহার করতে গেলে অনুমতি আদায় করতে হতো ‘বিশ্বভারতী’র সঙ্গীত বিভাগীয় বোর্ডের। নজরুল ভেবেছিলেন যেখানে তিনি নিজে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন সেখানে বিশ্বভারতী কোন আপত্তি করতেই পারে না। তাই সেই সহজ বিশ্বাসে অটল থেকেই সম্পূর্ণ করেন গান রেকর্ডিংয়ের কাজ। কিন্তু বিপত্তি ঘটল ‘ট্রেড শো’-এর দিন। আপত্তি জানালো বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বের করা হল বেশ কয়েকটি খুঁত। ফলতঃ মিলল না ছবি রিলিজের ছাড়পত্র। আটকে গেল ‘গোরা’র মুক্তি। কী হবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না নজরুল আর ছবির প্রযোজক। কোনো দিক না তাকিয়ে তারা ছুটলেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে।
নজরুলের মুখ থেকে সমস্ত ঘটনা শোনার পর বেশ অসন্তুষ্টই হলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বেশ চটে গেলেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের ওপর। বেশ অসন্তোষের সুরেই বললেন,“কী কাণ্ড বল তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরে…? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে! আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?”। রবীন্দ্রনাথের এরকম কথায় যেন পাহাড় সরে গেল নজরুলের মাথা থেকে।রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ ভরসা ছিল তার অনুজ নজরুলের উপর। তাই নজরুলের বলা সত্বেও, রবি ঠাকুর বললেন, “ছবি দেখাতে চাও সকলকেই দেখাও, সবাই আনন্দ পাবে। আপাতত দাও কীসে সই করতে হবে।” আর তারপরই তিনি সই করে দিলেন নজরুলের আগে থেকে লিখে নিয়ে যাওয়া অনুমতিপত্রে। এতটাই গভীর আস্থা ছিল তাঁর নজরুলের প্রতি। এরপর নির্দিষ্ট দিনেই সাড়ম্বরে মুক্তি পেল ‘গোরা’। আর তার সাথে সাথেই ভারতবাসী পেল ‘গোরা’ সিনেমায় ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক অন্যরূপ। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, পরবর্তীকালেও তা নিয়ে কোনদিনও কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমনই ছিল রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের বন্ধন।
Discussion about this post