খাদ্যরসিক আর ভোজনরসিকের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। খাদ্যরসিক খাবারের রূপ-রস-স্বাদ-গন্ধ গ্রহণ করেন, তাঁর কাছে খাদ্যের পরিমাণ প্রধান নয়। আর ভোজনরসিক শুধু খাবার উদরস্থ করতে ভালবাসেন। বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথকে চিনতে চিনতে আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, যে তিনি ওই প্রথম দলেই পড়েন।
‘জীবনস্মৃতি’তে তিনি লিখছেন, ভৃত্য ব্রজেশ্বর কীভাবে হাতে লুচি নিয়ে জিজ্ঞেস করত আর চাই কিনা, উত্তর না-বাচক হলেই সে হত খুশি। সেই ছোট বয়সেও লুচি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ভৃত্যের ওই মনস্তত্ত্বকে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। ছোট্ট রবির কাছে খাদ্যরসনা ততখানি জরুরিও ছিলনা, “তখনকার দিনে এই পৃথিবী বস্তুটার রস কী নিবিড় ছিল, সেই কথাই মনে পড়ে।“ তবে একথা বললে ভুল হবে যে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের খাদ্যপ্রেম তথা লুচিপ্রেমের প্রকাশ কখনও ঘটেনি!
একবার রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা একসঙ্গে বসে সকালের জলখাবার খাচ্ছিলেন। গান্ধীজি লুচি পছন্দ করতেন না, তাই তাঁকে ওটসের পরিজ খেতে দেওয়া হয়েছিল। উল্টো দিকে খাদ্যবিলাসী রবীন্দ্রনাথ খাচ্ছিলেন গরম গরম তেল চুপচুপে লুচি। গান্ধীজি সেসব দেখে বেশ শঙ্কা নিয়ে বলে উঠলেন, “গুরুদেব, তুমি জানো না যে তুমি বিষ খাচ্ছ।” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বললেন, “বিষই হবে; তবে এর অ্যাকশন খুব ধীরে। কারণ, আমি বিগত ষাট বছর যাবৎ এই বিষ খাচ্ছি।” এই লুচিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথই তাঁর ‘সৌন্দর্য্য’ প্রবন্ধে বলেন, যা অনেক মানুষের পছন্দ, যা মানুষের চোখে ভাল বলে বিবেচিত হয় সেগুলোই যদি সৌন্দর্য্যের প্রতীক হত, তাহলে “লোকে অবসর পাইলে ফুলের বাগানে বেড়াইতে না গিয়া ময়রার দোকানে বেড়াইতে যাইত, ঘরের দেয়ালে লুচি টাঙ্গাইয়া রাখিত ও ফুলদানীর পরিবর্ত্তে সন্দেশের হাঁড়ি টেবিলের উপর বিরাজ করিত!” এই মন্তব্য থেকেই রবীন্দ্রনাথের পরিমার্জিত নান্দনিকতাবোধকে বোঝা যায়।
আবার এই লুচিকে অস্ত্র করেই সমাজে ফাঁপা ধর্মপ্রচারকে আঘাত করেছেন কবি তাঁর ‘ধর্মপ্রচার’ কবিতায়। “স্বামী যবে এল যুদ্ধ সারিয়া/ ঘরে নেই লুচি ভাজা! আর্যনারীর এ কেমন প্রথা/ সমুচিত দিব সাজা। যাজ্ঞবল্ক্য অত্রি হারীত/ জলে গুলে খেলে সবে– মারধোর ক’রে হিন্দুধর্ম/ রক্ষা করিতে হবে। কোথা পুরাতন পাতিব্রত্য,/সনাতন লুচি ছোকা– বৎসরে শুধু সংসারে আসে/একখানি করে খোকা।’’ ‘সনাতন লুচি’র প্রসঙ্গ তুলে তিনি যে ‘মারধোর করে হিন্দুধর্ম রক্ষা’কে ব্যঙ্গ করলেন, তা বুঝে নিতে পাঠকের অসুবিধে হয়না। একেই বলা যেতে পারে খাদ্যের রূপ-রস-স্বাদ-গন্ধ-চরিত্র-ইতিহাসকে গ্রহণ করা। খাদ্যরসিক রবীন্দ্রনাথ সফলভাবে তা করেছেন।
Discussion about this post