কথায় আছে, ‘শীতের কাঁথা, বর্ষার ছাতা আর গরমের পাখা’ এ যেন বাঙালির জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে সময়ের সাথে বদলেছে বাঙালির জীবনযাত্রার মানও। তবে ইনভার্টারের যুগে বাঙালির শৈশব থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে লোডশেডিংয়ের অমূল্য স্মৃতি। লাইট নেভার সাথে সাথেই সবাই ছাদে কিংবা উঠোনে ভিড় করত, সাথে চলত ভূতের গল্পের আড্ডা। সাথে থাকতো হ্যারিকেন আর তালপাতার হাতপাখা। বিগত কয়েক দশক ধরেই কাটোয়ার বাগটোনা গ্রাম তালপাতার পাখার জন্য বিখ্যাত। তবে আধুনিকার দাপটে তালপাতার পাখা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। তাতেই মাথায় হাত শিল্পীদের।

বর্তমান সময়ে গরম পড়তে না পড়তেই মাথার ওপর বনবন করে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। তবে প্রাচীন সময়ে বেশিরভাগ মানুষই নির্ভরশীল ছিলেন তাল পাতার পাখার ওপরেই। জানা যায়, গ্রিক রোমান সভ্যতার যুগ থেকে চলে আসছে এই হাত পাখার ব্যবহার। তবে সময়ের সাথে হাত পাখার বিবর্তনও হয়েছে অনেকখানি। প্রথমদিকে তাল পাতার পাখাগুলিতে কোনো ভাঁজ ছিল না। তবে পরে কিছু ইউরোপীয় বণিক চিন, জাপান থেকে ফোল্ডিং বা ভাঁজওয়ালা পাখার ব্যবহার শেখেন। এক সময় ধীরে ধীরে বাঙালির বনেদিয়ানার চিহ্ন হয়ে উঠেছিল রকমারি নকশার হাতপাখা। পাখার ওপর সেই সময় নানা রকম নকশার সঙ্গে মণি মানিক্য অবধি বসানো হত। রঙিন কাপড়ের ঝালর এবং সুতো দিয়ে বোনা নানা ধরনের নকশায় তৈরী হতো বাহারী নকশী পাখা। পাখায় নকশার মাধ্যমে তুলে ধরা হত তখনকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনকে।

কাটোয়ার শ্রীখন্ড বাগটোনা গ্রামের থান্ডার পাড়ার হস্তশিল্পীরা বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে পাখা শিল্পের সাথে যুক্ত। নিপুণ শিল্পকলায় এই পাখা তৈরি করেন এখানকার শিল্পীরা। প্রবীণ এক পাখাশিল্পীর মতে, “সাধারণত হাতপাখা তৈরি হয় দু-তিন খেপে। প্রথমে তালগাছের পাতা কেটে, জলে ডুবিয়ে জাঁক দিয়ে সেই পাতা সোজা করা হয়। তারপর সেই পাতা সাইজ করে কেটে, ভালো করে বেঁধে, রং করে বাজারে ছাড়া হয়।”

তবে প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতির ফলশ্রুতিতে আজ বিলুপ্তির পথে এই ঐতিহ্যবাহী পাখা শিল্প। বাগটোনার পাখা শিল্পীদের কথায়, “এক সময় চৈত্র থেকে শ্রাবণ পর্যন্ত পাখার এত চাহিদা থাকতো, একটু জিরোনরও সময় পাওয়া যেত না। এই পাখা বিক্রি হয় কাটোয়ার পাশ্ববর্তী কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, ভাতার অঞ্চলে। এমনকি বর্ধমান ছাড়িয়ে বীরভূমেও এই পাখার বিশেষ চাহিদা ছিল। ছোটো বড়ো বিভিন্ন মেলায় জমিয়ে কেনাবেচা চলত হাতপাখার। তবে এখন এই পাখার চাহিদা প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে।” তবে ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেষ্টায় আজও লন্ডনের গ্রিনিচের বিখ্যাত মিউজিয়ামে রয়েছে এই হাত পাখার প্রচুর নিদর্শন।
চিত্র ঋণ – বাংলার চাষবাস
Discussion about this post