রূপ-বৈচিত্র্যে বাংলা যেমন মুগ্ধকর ও অনন্য তেমনি শিল্পে-ঐতিহ্যেও কিছুমাত্র কম যায় না। বাংলার শিল্প, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কারিগরি সুচারুতার মেলবন্ধন বাংলাদেশের তাঁত শিল্প। সত্যি বলতে গেলে, শাড়ি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শিল্পের ধারক ও বাহক। এদেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে নানান রকমের অসম্ভব সুন্দর সব শাড়ির ইতিহাস। ঢাকাই মসলিন, জামদানী, টাঙ্গাইলের তাঁত, সিলেটের মণিপুরী, রাজশাহী সিল্ক কিংবা মীরপুরের বেনারসী শৈল্পিক আভিজাত্যে যেমন অতুলনীয়, তেমনই গুণাগুণ ও মানে ততোধিক আকর্ষণীয়ও বটে! বলতে গেলে, বাংলাদেশের তাঁত শিল্পটি বৃহত্তম কুটির বা লোকশিল্পও বটে। এর মধ্যে সিলেটের মণিপুরী বস্ত্র শিল্প এই শিল্পের মধ্যে অন্যতম অবদান রেখেছে।
‘মণিপুরী’ বাংলাদেশে বসবাসকারী একটি জাতি গোষ্ঠীর নাম। তাদের আদি বসতি ভারতের মণিপুর রাজ্যে। বর্তমানে বাংলাদেশে দেড় লাখেরও বেশি মণিপুরী বাস করে। কথায় আছে, মণিপুরী মেয়েরা জন্মগত ভাবে তাঁতি এবং প্রায় ৯০ শতাংশ নারী তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। জানা যায়, এই জাতি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে শুরু থেকেই নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করে পরতো। এভাবে তাদের পোশাক এক সময় জনপ্রিয়তা পেতে থাকে এবং তারা বাণিজ্যিকভাবে কাপড়-বোনা শুরু করে। এই মণিপুরীরা সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকায় বাস করে। সিলেটের বিভিন্ন স্থানে এই মণিপুরী তাঁত শিল্পের অস্তিত্ব থাকলেও মৌলভীবাজার জেলায় এর ব্যাপকতা রয়েছে অনেক বেশি।
মণিপুরী তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য অনেক পুরনো। বিখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতা এবং হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণকাহিনীতেও এই বস্ত্র শিল্পের উল্লেখ রয়েছে। সিলেটের মণিপুরী শাড়ি তাদের সৌন্দর্য্য, ঐতিহ্য এবং গুণমানের জন্য বিখ্যাত। এই শাড়ির ঐতিহ্যবাহী নকশা এবং বুনন পদ্ধতি প্রায় সকলেরই নজর কাড়ে। এগুলি সাধারণত উজ্জ্বল রঙের সুতো দিয়ে বোনা হয় এবং তাদের জটিল নকশাগুলি মণিপুরী সংস্কৃতি এবং ধর্মকে প্রতিফলিত করে। মণিপুরী শাড়ি সাধারণত মোয়াং বা পাং তাঁতে বোনা হয়। মোয়াং তাঁতে সাধারণত মোটা সুতোর কাপড় তৈরি করা হয় এবং পাং তাঁতে সরু সুতোর কাপড় তৈরি করা হয়। মণিপুরী শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হল জমিনের রঙের থেকে পাড়ের রঙ গাঢ় থাকে। তাই দূর থেকে নজর কাড়ে। এই শাড়ির নকশাগুলি সাধারণত উদ্ভিদ, প্রাণী এবং ধর্মীয় প্রতীকগুলির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। মাইরাংগ বা মণিপুরী মন্দির এই শাড়ির সবচেয়ে সাধারণ নকশাগুলির মধ্যে একটি।
এই শাড়ি তৈরির সময় কোনরকম মেশিনের ব্যবহার করা হয় না। কাপড় তৈরির সুতোগুলোও চরকায় তৈরি। আরামদায়ক এবং হালকা ওজনের এই শাড়িটির স্বতন্ত্রতা এটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। বর্তমানে দেশে বিদেশে মণিপুরী শাড়ির চাহিদা রয়েছে। সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে মণিপুরীদের হাতে বোনা কাপড়ের দোকান। প্রায়ই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে সেই সব দোকানে।
Discussion about this post