শুধুমাত্র গায়ের রঙের জন্য মানুষটিকে নিজের বাড়ি, নিজের সংস্কৃতি, নিজের শহর, নিজের কাছের মানুষ-বন্ধু-বান্ধব সমস্ত ত্যাগ করে পালাতে হয়েছিল; নিজের দেশ ছাড়তে হয়েছিল। যাঁকে দীর্ঘ সময় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল, তিনি আজ তাঁর নিজের দেশের সম্পদ তো বটেই, সারা বিশ্বের একজন অন্যতম বিখ্যাত জ্যাজ পিয়ানিস্ট এবং কমপোজার। ইউরোপিয় শ্বেতাঙ্গদের তৈরি কট্টর বর্ণবাদের জেরে দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন গান। তিনি আবদুল্লা ইব্রাহিম। আজ ৯০ বছর বয়সে তাঁর সৃষ্টিগুলি নিয়ে তিনি বেরোবেন ‘ওয়ার্ল্ড ট্যুরে’!
১৯৩৪ সালের ৯ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম। বাবা-মার দেওয়া নামটি ছিল অ্যাডলফ জোহানস ব্র্যান্ড। পরে ধর্ম পরিবর্তন করেছিলেন তিনি। কেপটাউনে তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের ট্রাফালগার হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। সাত বছর বয়স থেকে পিয়ানো শিখতে শুরু করেছিলেন তিনি, তাঁর মা চার্চেই পিয়ানো বাজাতেন। পরিবার ধর্মপ্রাণ হওয়ায় নিয়মিত চার্চে যাতায়াত ছিল তাঁর। সেখানেই গসপেলের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। পরবর্তীকালে আমেরিকান জ্যাজ, মারাবি, এমবাকাঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি সঙ্গীত ঘরানার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। সেসবের মিশ্রণও যেমন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে পাওয়া যায়, আবার তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবও পাওয়া যায় তাঁর পরবর্তীকালের সঙ্গীত চিন্তার মধ্যে।
১৯৬২ সালে ইব্রাহিম তাঁর স্ত্রীয়ের সঙ্গে নির্বাসনে যান। প্রথমে জুরিখে, পরে আমেরিকায়। সেখানকার মানুষ, সংস্কৃতি এবং সঙ্গীতের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। তিনি বিভিন্ন গুণী ও প্রতিষ্ঠিত মানুষের সঙ্গে বিখ্যাত বিখ্যাত জায়গায় পারফর্ম করতে শুরু করেন। তৈরি হয় তাঁর ব্যান্ড ‘দ্য ডলার ব্র্যান্ড ট্রায়ও’। মানুষের কাছে অচিরেই তিনি বেশ পরিচিতি লাভ করেন। তৈরি হয় তাঁদের নিজস্ব রেকর্ড লেবেল। ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেলে সেই মুক্তিকে উদযাপন করতে তিনি কনসার্ট আয়োজন করেন। জীবনের বেশিরভাগ সময়েই তিনি বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
একজন সুরকার হিসাবে তাঁর কাজ এবং পিয়ানো বাদন অনেকের মধ্যে আলাদা হয়ে ওঠে বিভিন্ন ঘরানার মিলন দিয়ে। তিনি বাঁশি, চেলো এবং সোপ্রানো স্যাক্সও বাজিয়েছেন যা তাঁকে সমবেত বাজনার অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে। তিনি অসম্ভব সুন্দর সুর সৃষ্টি করেছেন। তবে তাঁর সুরের হারমোনি, ছন্দ এবং পিয়ানোর প্রবাহ তাঁর রচনাগুলিকে অসামান্য করে তুলেছে। ১৯৬০এর সৃষ্টিগুলিতে রয়েছে আভাগার্ড সুর ; ১৯৭০ থেকে ‘৮০র সৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে রয়েছে আফ্রিকা। ১৯৯০তে বর্ণবাদের পতনের সঙ্গে তাঁর সুর হয়ে উঠেছে আরও আবেগপূর্ণ। এই সমস্তকিছু নিয়েই তিনি ৯০ বছর বয়সে বেরোচ্ছেন ‘ওয়ার্ল্ড ট্যুরে’।
Discussion about this post