মানুষের জীবনে কিছু মুহূর্ত এমন আসে, যা চিরকালের জন্য স্মৃতিতে গেঁথে থাকে। ভালোবাসা, আবেগ এবং বেদনার এই মিশ্রণ যখন রাষ্ট্রীয় সীমানার বেড়া ভেদ করে ফেলে, তখন সেই মুহূর্তগুলো হয়ে ওঠে আরও গভীর, আরও তীব্র। তেমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। নদিয়া জেলার মাটিয়ারী সীমান্তের জিরো লাইনে, আজ ভারতের বাসিন্দা শরিফুল মণ্ডলের মরদেহকে আজ শেষবারের মতো নিয়ে যাওয়া হলো তাঁর বাংলাদেশি বোন রুকসানা বেগমের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য। এ ছিল জীবনের শেষ দেখা, আর তার মধ্যে মিশে ছিল সীমান্তের কাঁটাতারের চেয়ে আরও কঠিন, ক্রূর এক বাস্তবতা।
শরিফুল মণ্ডল, বয়স ৫২ বছর, দীর্ঘদিন ধরেই শয্যাশায়ী ছিলেন। অসুস্থতা তাঁকে জীবনের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। সেই মৃত্যুশয্যায় থেকেও ভাইয়ের মনে ছিল একটাই ইচ্ছা— শেষবারের মতো বোন রুকসানার মুখ দেখা। কিন্তু রাজনৈতিক সীমারেখা ও কূটনৈতিক জটিলতা সেই সহজ কাজটিকেও কঠিন করে তুলেছিল। বাংলাদেশে বসবাসরত রুকসানার পক্ষে ভারতের মাটিতে আসা সম্ভব ছিল না, এবং শরিফুলের পরিবারের পক্ষে ভাইয়ের ইচ্ছা পূরণ করা হয়ে উঠছিল আরও দুঃসাধ্য। শরিফুলের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা শেষ চেষ্টা হিসেবে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর দ্বারস্থ হন। তাদের একান্ত আবেদন, ভাইয়ের মরদেহ যেন বোনের কাছে পৌঁছানো যায়, অন্তত একবারের জন্য হলেও। বিএসএফ এই আবেদনের গুরুত্ব বুঝে, কূটনৈতিক বাধাগুলো উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে। দুই বাহিনীর মধ্যে একটি বৈঠকের পর, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে শরিফুলের মরদেহ জিরো লাইনে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে তাঁর বোন রুকসানা শেষবারের মতো ভাইকে দেখতে পাবেন।
শুক্রবার সেই হৃদয়বিদারক মুহূর্তটি আসে। জিরো লাইনে নিয়ে আসা হয় শরিফুলের মরদেহ, আর সীমান্তের ওপার থেকে আসেন রুকসানা বেগম। ভাইয়ের মরদেহ স্পর্শ করেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কাঁটাতারের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং উপস্থিত জনতা সেই মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলেন— যেখানে মানুষের আবেগ আর ভালোবাসা কোনো সীমানায় বেঁধে রাখা সম্ভব হয়নি। বিএসএফ এবং বিজিবি, উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় এক ভাই-বোনের শেষ দেখা হয়ে উঠল স্মরণীয়। যদিও সেই দেখা ছিল বেদনায় ভরা, তবুও সেই মুহূর্তে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও এই আবেগঘন মুহূর্তের গুরুত্বকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল।
Discussion about this post