সত্যজিৎ খ্যাত ফেলুদার সিধু জ্যাঠা এক অতি জনপ্রিয় চরিত্র। তবে সিধু জ্যাঠার বাস্তবে সত্যিই কোনও অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কারণ এটা যিনি বলতে পারতেন তিনি মানে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় এ বিষয়ে তেমন কিছু বলে যাননি। তবে হ্যাঁ, সিধু জ্যাঠার সঙ্গে বাস্তবের এক মানুষের সাদৃশ্য পাওয়া গেছে। সেই বিখ্যাত সিধু জ্যাঠার আসল নাম নির্মলচন্দ্র কুমার। কলকাতার ইতিহাস নিয়ে যাঁরা পড়াশুনা করতে ভালবাসেন তাঁরা রাধাপ্রসাদ গুপ্তের নাম শোনেননি সেটা হতেই পারে না। সেই গবেষক ও প্রাবন্ধিক রাধাপ্রসাদ গুপ্ত জানিয়েছেন পুরনো বই কেনায় নির্মলচন্দ্র কুমার ছিলেন পুরোদমে নেশাগ্রস্ত। ৩০ বছর বয়স থেকেই নির্মলচন্দ্রকে দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহের নেশা পেয়ে বসেছিল। কাউকে নিজের সংগ্রহের বই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়তে দিতে নারাজ ছিলেন তিনি। তবে যাঁরা যত্ন নিয়ে বই পড়তেন বা বই পড়ার সময় মলাট লাগিয়ে নিতেন তাঁদের প্রতি তিনি সদয় ছিলেন। এরমই সুযোগ পেয়েছিলেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ও সত্যজিৎ রায়। এর কারণ একটাই দু’জনেই যে খুব যত্নসহকারে বই পড়তেন।
প্রথম জীবনে নির্মলচন্দ্র কুমার কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে বই সংগ্রহ করবার সময় সেখানেই তাঁর রাধাপ্রসাদ গুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয়। আর রাধাপ্রসাদই নির্মলচন্দ্র কুমারের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। রাধাপ্রসাদ গুপ্তের লেখা থেকে জানা যায় নির্মলচন্দ্র কুমারের ঘরের চারদিকের দেওয়াল জুড়ে ছাদ অবধি ছিল খালি বই আর বই। সেই ঘরের এক কোণার তক্তপোশে একটা হাতাওয়ালা গেঞ্জি আর ধুতি পরে শান্ত চেহারায় শিবের মতন বসে থাকতেন তিনি। কি সিধুজ্যাঠার ছবির সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য কি পাচ্ছেন? আসলে নির্মলচন্দ্রের সঙ্গে সিধুজ্যাঠার আদলের কথা প্রথম রাধাপ্রসাদ গুপ্তই উল্লেখ করেন। তবে একটা মুশকিল আছে। ‘সোনার কেল্লা’ ছাড়াও সত্যজিতের অন্যান্য কয়েকটি উপন্যাস যেমন ‘কৈলাশে কেলেঙ্কারি’, ‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’ ইত্যাদিতে সিধু জ্যাঠার চরিত্র থাকলেও তাঁর কোনও ছবি ছিল না। অনন্ত জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে সিধুজ্যাঠা স্ক্র্যাপবুকে খবরের কাগজ কেটে রাখতেন। নির্মলচন্দ্র কুমারেরও পেপার ক্লিপিং রাখার এমন একটি স্ক্র্যাপবুক ছিল। অনুমান করা যেতে পারে সত্যজিৎ রায় কোনও সময় সেটি দেখেছিলেন।
যেহেতু রায়বাবু নিজের সৃষ্ট চরিত্র সিধু জ্যাঠা নিয়ে সোজাসুজি কোনও কথা স্পষ্ট করে বলে যাননি তাই কার আদলে সিধুজ্যাঠা তৈরি তা নিয়ে সত্যজিৎ গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। নিবন্ধকার প্রদীপ সেবাস্তিয়ান এক সংবাদপত্রে লেখেন যে সম্ভবত নির্মলচন্দ্রই হলেন সত্যজিৎকৃত সিধুজ্যাঠা চরিত্রটির রোল মডেল। এছাড়া নির্মলচন্দ্রের পুত্র অলোক কুমার জানান, তাঁর শাটুল কাকা (মানে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত) সরাসরি না বললেও একথা হাবে-ভাবে বুঝিয়েছেন যে তাঁর বাবার আদলেই সিধু জ্যাঠা চরিত্রটি তৈরি হয়েছে। তবে অনেকেই এই তথ্য মানতে রাজি নন। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, কোনও বিশেষ একজনের আদলে সিধুজ্যাঠা চরিত্রটি তৈরি হয়নি, সত্যজিৎ ঘনিষ্ঠ আরও অনেকের মিলিত ইমেজই হলেন সিধুজ্যাঠা।১৯৭৪ সালে তৈরি হয় ‘সোনার কেল্লা’। তাতেই প্রথম দেখা যায় সিধু জ্যাঠারূপী হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’র প্রস্তুতি পর্বে রায়বাবুর কাছে নির্মলচন্দ্র কুমার কল্পনার সিধু জ্যাঠার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। সত্যজিৎ বাবুর প্রয়োজন ছিল সিপাহী বিদ্রোহ সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথির। নির্মলচন্দ্রর কাছে খবর আসে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত নিলাম কেন্দ্র সদবিজ একটি স্ক্র্যাপবুক নিলাম করতে চায়, যা ১৮৫৬ সালে সিপাহি বিদ্রোহের বিষয়ে কাগজের ক্লিপিং সংগ্রহ করে তৈরি। শুনলে বিস্মিত হবেন নির্মলচন্দ্র কুমার সেই আমলে প্রায় ১০০ পাউন্ড খরচা করে সেই স্ক্র্যাপবুক কিনে সত্যজিৎকে দেন।
১৯৭৬ সালে মাত্র ৬০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নির্মলচন্দ্র কুমারের অকালে মৃত্যু হয়। প্রায় কুড়ি বছর হোমওয়ার্কের পরে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ তিনি দেখে যেতে পারেননি। নির্মলচন্দ্র কুমার মারা যাওয়ার পর শোকস্তব্ধ সত্যজিৎ তাঁর কাছে থাকা আরও অনেক বইয়ের সঙ্গে সেই দুষ্প্রাপ্য স্ক্র্যাপবুক ফেরৎ দিয়েছিলেন। সেই সব অমূল্য সংগ্রহকে নষ্ট হতে দেননি তাঁর ছেলে অলোক কুমার। আর একটি কথা, নির্মলচন্দ্র কুমারের পুরনো ঠিকানার বদল ঘটেছে। বর্তমানে তাঁর সমস্ত সংগ্রহ গচ্ছিত আছে পুত্র অলোক কুমারের লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে।
Discussion about this post