নদিয়ার এক অন্য ঐতিহ্য শিকারপুর চার্চ। যার কথা বলতে গেলে ফিরতে হবে ১৮৭০ দশকের শেষের দিকে। সে সময়ে অবিভক্ত বাংলা। নদিয়ার শিকারপুরের চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল মেদিনীপুরের নীলকর সাহেবদের জমিদারি। প্রায় ১৫২টা তালুকের সদর কার্যালয় ছিল এই শিকারপুর। তবে এ অঞ্চলে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল বা হাসপাতাল কিছু ছিল না। এই অসুবিধা মেটানোর কারণে শিকারপুর নীলকর সাহেবেরা ইংল্যান্ডের বন্ধু মহলে একটা লিখিত প্রার্থনা জানালেন। উদ্দেশ্য ছিল শিকারপুরে একটি মিশন কেন্দ্র স্থাপন।
অবশেষে তিন ইংরেজ বন্ধুর সহায়তায় গড়ে ওঠে শিকারপুর মিশনারি কেন্দ্র। বন্ধুদের মধ্যে একজন, রবার্ট ডাডলে স্মিথ ( ১৮৩০- ১৮৯৭) তাঁর সম্পত্তি মিশন কেন্দ্র তৈরির জন্য দান করেন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে মিশনকেন্দ্র তৈরি শুরু হয়। সেখানকার শান্ত পরিবেশ দেখে নামকরণ করা হয় শান্তিরাজপুর। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে একটা প্রাইমারি স্কুল, একটা ডিসপেন্সারি, একটা মিশনারি বাংলো, কয়েকটি কর্মচারী কোয়ার্টার ও ঘোড়ার গাড়ির আস্তাবল। এছাড়াও আলাদা স্থান জুড়ে তৈরি করা হয় কবর স্থান। এই মিশনারি কেন্দ্রে প্রথম মিশনারি হয়ে আসেন রেভাঃ সি এইচ গিল। সালটা ১৮৬৬। তিনি আসার পর, পাকা গির্জাঘর তৈরি আরম্ভ হয়। এরপর ১৮৯০ সালে ৭ ই ডিসেম্বর, কলকাতার লর্ড বিশপ এডওয়ার্ড এই গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা উপাসনা পরিচালনার জন্য বল্লভপুর (এখন বাংলাদেশ) থেকে রেভাঃ কৈলাস চন্দ্র দে আসেন। সেকালে গির্জার দান হিসেবে সংগ্রহ হয় ৬৭ টাকা ১০ আনা। যদিও তা সবটাই ডিস্পেন্সারির জন্য দেওয়া হয়। পরবর্তীতে উপাসনা মন্দিরের নামকরণ করা হয় – ‘ক্রাইস্ট চার্চ’।
এই চার্চ আসলে তৈরি হয় ইংল্যান্ডের এক গ্রাম্য উপাসনা গৃহের আদলে। এখানে দর্শনীয় বলতে বেদীর অর্থবহ রঙিন তিনটি জানালা। অন্যদিকে উপভোগ করার মত রয়েছে শ্রুতিমধুর ঘণ্টা সমষ্টির ধ্বনি। প্রতিটি রঙিন জানলাতে একটি করে বাইবেলের পদ উল্লেখ করা আছে। আর ঘণ্টাঘরে বসানো আছে অপূর্ব ঘন্টাগুলি। পরপর বসানো পাঁচটি ধাতব নাদের সমষ্টিতে তৈরি এই ঘণ্টা। এর স্বরশৈলী — সা-রে-গা-মা-পা। ছোটো ছোটো গান বাজানো যায়। বর্তমানে এর আওয়াজ আগের মত নেই ঠিকই তবু সুর মানেই মিষ্টি একটা আওয়াজ।
হঠাৎই ১৯৪৭ সালে নেমে এল দুর্দিন। বাংলা ভাগের কাল। দেশে ধর্মীয় অশান্তি হল। দেশভাগ হয়ে গেলে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্থ হল এই বাংলা। বিশাল ধাক্কা এল শান্তিরাজপুর মিশন কেন্দ্রেও। একে একে বিশপেরা পাড়ি জমায় অন্য দেশে। পরবর্তীতে ব্যারাকপুর বিশপ মালাকার ও দমদম সেন্ট স্টিফেন্স স্কুলের প্রিন্সিপাল, শ্রী হরিপদ দাস মহাশয়, উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় শান্তিরাজপুরপুর কেন্দ্রকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে এখানে এক খণ্ড জমি ক্রয় করে ২০০৬ সালের ১ জুলাই শিকারপুর সেন্ট স্টিফেন্স্ স্কুল স্থাপন করেছেন। সেই সময় মাত্র ৬৪ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হয় নতুন উদ্যমে। সমস্ত কিছু আগের মত একইরকম না থাকলেও বেঁচে আছে গোটা শতাব্দীর সাক্ষী ‘শিকারপুর মিশনারি কেন্দ্র’।
চিত্র ও তথ্য ঋণ – বঙ্গদর্শন
Discussion about this post