ট্রাম মানেই টিং টিং টিং ঘন্টি। কাঠের চেয়ার আর খোলা জানালা। ছাদে আটকানো গোল খাঁচার মধ্যে ফ্যান লাগানো প্রথম শ্রেনী আর নাহলে ফ্যানবিহীন দ্বিতীয় শ্রেনী। তিলোত্তমার মাঝ দিয়ে মন্থর গতিতে দুলকি চালে সে চলেছে গজগমনে, সারা শহর যখন ব্যস্ততার তুঙ্গে তখন ট্রামের কিন্তু কোনো হেলদোল নেই। এই দৃশ্যের সাথে প্রায় আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু হাওড়ার শিবপুর ট্রাম ডিপো! বর্তমান প্রজন্ম যে নামটিকে শুধু একটা বাস স্টপেজ হিসেবেই জানে। অনেকের মনে তো এমন প্রশ্নও এসেছে যে নাম ট্রাম ডিপো হলে ট্রাম গুলো কই, আর লাইনগুলোই বা গেল কোথায়?
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, হাওড়াতেও আলাদা করে ট্রামরুট ছিলো একসময়। জানা যায় যে, হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটি কলকাতার ট্রাম কোম্পানিকে ১৯০৭ সালে ট্রাম লাইন খোলার অনুমতি দেয়। উত্তর ও দক্ষিণ- এই দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল ট্রাম লাইনটি। উত্তরের লাইন দুটির একটি ছিল হাওড়া ব্রিজ থেকে শুরু করে সালকিয়া বাঁধাঘাট রোড ও ঘুসুড়ি রোড পর্যন্ত। আর অন্যটি ছিল পূর্ব গোলাবাড়ি রোড পর্যন্ত। অন্যদিকে দক্ষিণের লাইনটি হাওড়া ব্রিজ থেকে শুরু করে বাকল্যান্ড ব্রিজের ওপর দিয়ে হাওড়া কোর্টের ও ময়দান এর দিক দিয়ে কেওড়াপাড়া ঘাট পর্যন্ত। এটিই ছিল শিবপুরের লাইন আর তখন থেকেই এই স্টপেজের নাম হয় শিবপুর ট্রাম ডিপো।
৪০ নম্বর রুটের ট্রাম গুলো ছিল সেকেন্ড ক্লাস অর্থাৎ ফ্যানবিহীন। একটিই কামরা আর দুদিকে ইঞ্জিন। কেন দু’দিকে ইঞ্জিনের ব্যবস্থা ছিল জানেন? কারণ ট্রাম ডিপোতে গাড়ি ঘোরানোর জায়গা ছিল না তাই দু’দিকে ছিল ড্রাইভার কেবিন। ড্রাইভার শুধু কেবিন পরিবর্তন করে নিতেন। তবে সময়ের দাবিতে সবকিছুই বদলে যায়। তেমনি ১৯৭০ সালের ২৫ অক্টোবর ট্রাম কোম্পানি বাঁধাঘাট লাইনের ট্রাম বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। প্রতিবাদে ট্রাম কর্মচারীরা ধর্মঘটের ডাক দেন। প্রথমদিকে কোম্পানি তাদের দাবি মেনে ফের ট্রাম চালানোর অনুমতি দিয়েছিলেন বটে, তবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন আর পাঁচটা আন্দোলনের মতোই মুছে ফেলা হয়। বন্ধ হয়ে যায় বাঁধাঘাট লাইন। এক বছর পরে ১৯৭১ সালে বাঁধাঘাটের মতো শিবপুরের ট্রামও উঠে যায়। ১৯৭২ সালে হাওড়ার ট্রাম চিরতরে বিলীন হয়ে যায় রাজপথের গভীরে, রয়ে যায় শুধু তার জনপ্রিয়তা!
বর্তমানে বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে পুরোদমে যান চলাচল শুরু হবার পর মানুষজন ডিপোর বদলে মন্দিরতলা দিয়ে যাতায়াত করেন। ধীরে ধীরে ট্রাম ডিপোর মর্যাদাও ক্ষীণ হয়ে যায়। শিবপুরের ট্রামলাইন তো উঠে গেছে কবেই, ট্রাম লাইনও ডুবে গেছে কংক্রিটের অতল গভীরে। অবশেষে স্মৃতির পাতায় রয়ে গেল হাওড়ার ঐতিহ্যবাহী ট্রাম, রয়ে গেল স্মৃতিতে ৪১ আর ৪২ নম্বর ট্রাম।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – কলকাতা বাস ও পিডিয়া
Discussion about this post