মহামারীর ভয়াবহতায় ভারতীয় সিনেমা যখন দিশেহারা, সেই সময়ে পরিচালক অমিত মাসুর্কারের হিন্দি ছবি ‘শেরণি’ অবশ্যই এক রোমহর্ষক পরিবেশনা। জঙ্গল, আর জঙ্গলে বসবাসকারী প্রাণীকূলের প্রতি সঙ্গবদ্ধ উদাসীনতা আর ‘নেক্রো পলিটিক্সে’র এক অসামন্য দলিল এই ছবি। ছবির প্রেক্ষাপট প্রভাবিত হয়েছে ২০১৬ সালের জুন মাসে মহারাষ্ট্রের যবৎমল জেলার বরাট গ্রামে বাঘিনী অবনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে। পান্ধারকাওড়ার জঙ্গলে বসবাসকারী ১৩ জন মানুষ, এই দুই শাবকের মায়ের আক্রমণে প্রাণ হারায়। এরপর রাজ্য বনবিভাগ এই বাঘিনীকে ‘ম্যান ইটার’ নামে চিহ্নিত করে এবং সরকারী তৎপরতায়, ভাড়াটে শিকারীরা ঘিরে ধরে নিরীহ অবনীকে খুন করে। সমস্ত বৈজ্ঞানিক এবং প্রাণী তাত্ত্বিক যুক্তি, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধকে উপেক্ষা করে মহারাষ্ট্র রাজ্য বনবিভাগের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা প্রাধান্য দেন ‘ম্যান ইটারের’ মতো শতাব্দী পুরাতন, অপ্রমানিত, কু-মতবাদকে।
কিন্তু এই সিনেমা আসলে যে গূঢ় ত্বত্বের উপরে আলোকপাত করতে চেয়েছে, তার গভীরে পৌঁছতে গেলে আমাদের কম করে একশো বছর পেছিয়ে যেতে হবে। মনে করতেই হবে, কবে, কোথায়, কিভাবে এই দৈনতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল আমাদের দেশে!! কিভাবে যুক্তির বেড়াজালে আটকে, বন্যপ্রাণীর উপর চরম নৃশংসতাকেও সঠিক পদ্ধতি রূপে আইন প্রণয়ন করেছিলাম আমরা।
তখন সালটা ১৯১১, ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনাকাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজপাট তুলে নিয়ে গিয়ে, ভারতের নব্য নির্বাচিত রাজা পঞ্চম জর্জের হাতে তুলে দিয়েছিল। হৈ হৈ করে ১২ ডিসেম্বর, করোনেশন পার্কে ভারতবর্ষের নতুন ব্রিটিশ রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল। নতুন রাজা এবং রাণীর অভিষেকের মহাযজ্ঞে আপ্লুত হয়ে আনুগত্যপরায়ণ তৎকালীন ভারতীয় রাজা, জমিদার এবং সমাজের প্রভাবশালীদের ভিড় ছিল দেখার মতো। দশ দিন ধরে চলা সেই আনন্দোৎসবে নেপালের রাজা আনুগত্যের যৌতুক হিসেবে তাঁকে শিকারে আমন্ত্রণ করেন। ভারতবর্ষের রাজা হওয়ার আনন্দে পঞ্চম জর্জও তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে তরাইয়ের জঙ্গলে ৩৯ টি রয়াল বেঙ্গল টাইগার, ১৮ টি গন্ডার এবং ৪ টৎ ভালুককে ট্মারেন। উল্লসিত রাজা সেই সারি দেওয়া নিরীহ প্রাণীদের মৃতদেহর সামনে বীরের মতো ছবি তুলেছিলেন। অদ্ভুতভাবে সেদিনের সেই রোমহর্ষক ছবি আজও আমাদের চেতনার স্তরে ধাক্কা দিতে পারে নি। যদি দিত, তবে সেদিন ভারতবর্ষের জঙ্গলে বসবাসকারি এক লক্ষেরও বেশি রয়াল বেঙ্গল টাইগার কমে গিয়ে আজ ২৯৬৭-এ এসে দাঁড়াতো না।
যদিও এর বহুকাল আগে থেকেই ভারতবর্ষে শুরু হয়েছিল এই জঘন্যতম বীরত্ব প্রকাশের রীতি। তৎকালীন রাজা এবং জমিদারেরা জঙ্গল ঘিরে, নিরীহ বাঘেদের তাড়িয়ে-তাড়িয়ে কোণঠাসা করে তীর-ধনুক, বল্লম আর বন্দুকের গুলিতে তাদের শরীর ঝাঁঝরা করে দিয়ে শখ পূরণ করতেন। শুধু যে নিরীহ প্রাণীদের হত্যা করেই আনন্দ পেতেন, তা নয়, সেই সব মৃত প্রাণীদের শবের সাথে ছবি তুলতে এবং তাদের দেহাবশেষকে বাড়িতে সাজিয়ে রাখ্তে বিশেষ গর্ব অনুভব করতেন। আর এই কু-প্রথার হাত ধরেই বড়ো হয়েছিলেন প্রবাদ প্রতিম বন্যপ্রাণী হত্যাকারী ( শিকারী) জিম করবেট। উনিশ শতকের শুরুতেই ভারতীয় জন্মজাত, নৈনীতালের এই ব্রিটিশ যুবক হয়ে উঠেছিলেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ত্রাস। অতি অল্প সময়েই, এই অদম্য সাহসী তরুণ ব্রিটিশ, বাঘ-শিকারী হিসেবে নজর কেড়েছিলেন ভারতীয় রাজা-রাজড়াদের। আর কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ছাড়াই ‘ম্যান ইটার’ আখ্যা দিয়ে মৃত্যুর দরজা দেখিয়েছিলেন বহু নিরীহ বাঘেদের।
অতি অল্প বয়সে পিতৃহীন হয়ে জিম করবেট তার ষোলজন ভাই-বোনের এক বড় পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। স্কুলের গন্ডি পেরনোর আগেই, রেলের জ্বালানি ভরার চাকরিতে নিযুক্ত হন। চাকরির সুবাদে তার বন্দুক চালনার প্রশিক্ষণও হয়েছিল খুব কম বয়সে। আর সেই বিদ্যেকে মূলধন করেই ‘ম্যান ইটার টাইগার’ মেরে বাঘ শূন্য করে দিয়েছিলেন কুমায়ুন- গাড়ওয়ালের জঙ্গল। কুড়িয়ে নিয়েছিলেন সন্মান আর প্রতিপত্তি। মৃত বাঘের দেহাবশেষ ব্রিটিশ এবং ভারতীয় প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের উপহার দেওয়ার সুবাদে অতি অল্প বয়সেই তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন এলিট সমাজে। পরে অবশ্য, তাঁর জীবনের পঞ্চাশ বছর বয়সে বন্দুক ছেড়ে ক্যামেরা ধরে ছিলেন। একজন বন্য প্রাণী সংরক্ষণকারী বলে নিজেকে প্রমানিতও করেছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে, ভারতবর্ষে এই ‘ম্যান ইটার’ তত্ত্বের উদ্ভাবনও করেছিলেন এই জিম করবেট। আর সেই তত্ত্বের উপরে দাঁড়িয়েই পররর্তী সময়ে মানুষ-বাঘের লড়াই রুখতে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এ দেশে।
ভারতবর্ষের এই ম্যান ইটার মতবাদ এবং পৃথিবীর বৃহত্তর ব্যাঘ্র সংরক্ষণকে নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে, মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের, আলাবামা ইউনিভার্সিটির পলিটিকাল জিওগ্রাফীর প্রফেসার, জারেড মার্গুলিআস বিস্তর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরেছেন। তাঁর “Making the Man Eater: Tiger conservation as Necropolitics” রিসার্চ পেপারে ক্যামেরুনিয়ান দার্শনিক আচিলি এম্বেবে’র নেক্রো পলিটিক্সের তত্ত্বকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। জীবনকে, কোন শক্তি বা নিয়মের অধীনে রেখে, তার মৃত্যুকে পরিচালনা করার তত্ত্বকেই নেক্রো পলিটিক্স বলে আখ্যায়িত করেছিলেন দার্শনিক এম্বেবে। সেই ত্বত্ব অনুযায়ী ব্যাঘ্র সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একই রকমভাবে মানুষও বন্য প্রাণকে নিজেদের অধীনে রেখে, সুযোগ মতো নিয়মের বেড়াজালে, তার মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করছে। সংরক্ষণের নামে, এক চরমতম স্বাধীনতা বা বৃহত্তর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির আড়ালে এক ঠান্ডা মাথার ধনতান্ত্রিক সামন্তবাদ লুকিয়ে আমাদের এই সিস্টেমে।
শেরণি ছবিতেও, ক্রমশ ছোট হয়ে আসা জঙ্গল আর জংলি জানোয়ারদের প্রতিনিয়ত মানুষের সাথে লড়াইয়ের কাহিনীকেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে নিয়ম আর নিয়মের ফাঁক দিয়ে গলে যাওয়া চরমতম অনিয়মের কাহিনীকে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি পরায়ণ রাজনৈতিক নেতা আর সরকারি আধিকারিকদের চাপে, কীভাবে সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ আধিকারিকরা কোনঠাসা হয়ে যায়। ক্ষতি হয় জীববৈচিত্রের। ধীরে ধীরে কুক্ষিগত হয়ে যায় বন্যপ্রাণী। ডিএফও বিদ্যা ভিনসেন্ট-এর চরিত্রে বিদ্যা বালনের অসামান্য অভিনয় শেরণি ছবিকে যে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে, সে বিষয়ে কোন দ্বিমত হওয়ার কথা নয়। অসাধারন সিনেমাটোগ্রাফি আর চাপা উত্তেজনায় ভরা এই ছবি যে দর্শকের মনে এক অসহায়হীনতার সৃষ্টি করে তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু তাই নয়, অমিত মাসুর্কার এবং তার টিমের এই মানুষ আর বন্য প্রানীর সন্মিলিত সহবাস এবং তাদের প্রতিনিয়ত লড়াইয়ের কাহিনী অবশ্যই ভারতীয় সিনেমায় এক নতুন দিক উন্মোচন করেছে। এটি অবশ্যই মানুষকে ভাবতে এবং ভাবাতে সাহায্য করবে।
Discussion about this post