বাঙালি যুবকরা ব্যবসা করে না, অন্যের অধীনে ডেস্কে মাথা গুঁজে কাজ করতেই তাঁরা অভ্যস্ত। ব্যবসার ঝুঁকি নেওয়ার সাহস বা মানসিকতা কোনটিই তাঁদের নেই। স্বাধীনতার আগে শুধু নয়, স্বাধীনতার পরেও অনেকেরই এমনটাই ধারণা ছিল। স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্য’ সিনেমাতেও চাকরীর খোঁজে বের হওয়া সোমনাথকে (প্রদীপ মুখোপাধ্যায়) একথাই বলতে শোনা গিয়েছিল বিশুদার (উৎপল দত্ত) মুখে। পাশাপাশি শোনা গিয়েছিল গুজরাটি, মাড়োয়াড়িদের প্রশংসাও।
এখনও বাঙালিদের সম্পর্কে অনেক অবাঙালিরই এই ধারণা রয়ে গিয়েছে। এই ধারণা অনেক বাঙালিদেরও। কিন্তু, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই ব্যবসায় নেমে রীতিমতো ‘বিজনেস টাইকুন’ হয়ে উঠেছে অনেক বাঙালি তরুণ। ননীগোপাল মিত্রের ‘সুলেখা কালি’, গৌরমোহন দত্তের ‘বোরোলিন’ হয়ে উঠেছে বাঙালির অঙ্গ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই ব্যবসায় ঝুঁকতে শুরু করেন বেশ কিছু বাঙালি। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের কুখ্যাত বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিনত হয় পূর্ণাঙ্গ স্বদেশী আন্দোলনে। এই স্বদেশী আন্দোলন এশিয়ান পেইন্টস, টাটা স্টিল, ল্যাকমের মতো আরও অনেক আইকনিক ব্র্যান্ডের জন্ম দেয়। এই ব্র্যান্ডগুলি কেবল বিদেশী পণ্য বিক্রিকে কমিয়েই দেয়নি, ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছিল বাঙালিদেরও।
সেইভাবেই স্বাধীনতার আগে শিল্পপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন হাওড়ার এক বাঙালি তরুণ। তাঁর নাম প্রকৃতিনাথ ভট্টাচার্য। মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর রেল কর্মী দাদা বিভূতিভূষণের সঙ্গে হাওড়া জেলার শালিমারে চলে আসতে হয়েছিল শিশু প্রকৃতিনাথকে। শিবপুর দীনবন্ধু ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন। অধ্যাপক-পুত্র হলেও প্রকৃতিনাথের বাসনা ছিল শিল্প সাধনার। ফলে চাকরির বাইরে স্বাধীন ব্যবসার অদম্য ইচ্ছায় মত্ত প্রকৃতিনাথ স্নাতক হওয়ার পর স্থানীয় শিবপুর বাজারে গম-আটা পেশাইয়ের কল খুলেছিলেন। সালটা ১৯৩৭। শিবপুর দীনবন্ধু ইন্সটিটিউশনের শিক্ষক দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় ছাত্র প্রকৃতিনাথ’কে সেই সময় আটাচাকী খোলবার জন্য আড়াইশো টাকা দেন।
অন্যদিকে ‘শঙ্খ আটা কল’ দ্রুত জনপ্রিয়তা পেলেও ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ আর খাদ্য নিয়ন্ত্রণের সরকারি ফরমানের দরুন আটার কল বন্ধ হয়ে গেল। পরের বছরেই ক্ষুদ্র শিল্পের বিখ্যাত পরামর্শদাতা জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগীর পরামর্শে প্রকৃতিনাথ শালিমারে ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুল তৈরির কারখানা বানালেন ১৯৪৪ সালে। প্রথম বছর সাত-আট জন কর্মচারী নিয়ে কাজ করে অভূতপূর্ব সাফল্য পান তিনি। শালিমার থেকে কারখানা উত্তর কলকাতার নারকেলডাঙা মেন রোডে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয় এক বছরের মধ্যেই।
সেই বছরেই চেতলার পঞ্চানন মণ্ডলের সঙ্গে প্রকৃতিনাথ গড়ে তুললেন শালিমার কেমিক্যাল ওয়ার্কস প্রাইভেট লিমিটেড। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা পরিস্থিতিতে নারকেল তেল, তিল তেল, পাউডার তৈরির ইউনিট গুলি চেতলা, সাহাপুর আর রামকেষ্টপুরে সরানো হয়। শুরুর পরে প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত অপরিশোধিত নারকেল তেল কিনে তা পরিশোধন করে বিক্রি করতো শালিমার কোম্পানি। ১৯৫৫ সাল থেকে নারকেলের শাঁস কিনে তেল বিপণন শুরু হয়। দুজনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই প্রতিষ্ঠানের উচ্চতা ক্রমবর্ধিত হয়ে ওঠে যার স্বীকৃতি হয় বাংলার অন্যতম সফল শিল্পপতি হিসাবে। দেশজোড়া খ্যাতির অধিকারী হন প্রকৃতিনাথ ভট্টাচার্য। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই ১৯৫৯ সালে নরেন্দ্রপুরে ২৭ বিঘা জমিতে গড়ে উঠে শালিমার কেমিক্যাল ওয়ার্কস-এর নারকেল তেল তৈরির কারখানা। একে একে হায়দ্রাবাদে হয় আরও তিনটি কারখানা।
শুধু নারকেল তেল নয়। বর্তমানে রান্নাঘরেও পৌঁছে গেছে তাঁর নাম। গুড়ো মশলা শালিমার শেফ, সরষের তেল, নন-স্টিকি তেল তাদের অন্যতম পণ্য। যদিও এখনও শালিমারের নারকেল তেলই তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিক্রিত পণ্য। শালিমারের নারকেল তেল ব্যবহার করেননি, পশ্চিমবঙ্গে এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই বাঙালি ব্র্যান্ড ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা তথা ভারত ছাড়িয়ে বিদেশেও আজও সমানভাবে সমাদৃত।
Discussion about this post