একই উৎসব একই সময়ে প্রায় গোটা ভারতে প্রচলিত রয়েছে এমন নমুনা খুবই স্বল্প। ‘দশেরা’, ‘দীপাবলী’ এবং ‘দোল’- এই তিনটেই। প্রথম দুটির মধ্যে ধর্মীয় অনুষঙ্গ উৎসবমনস্কতার চেয়ে প্রবলতর, কিন্তু দোলে ধর্মানুষঙ্গটি প্রকৃতপক্ষে গৌণই হয়ে গেছে এর উৎসব মুখরতার কাছে। সেদিক থেকে দেখলে এটিই হল একমাত্র সার্বজনীন সর্বভারতীয় উৎসব যাতে ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায়ের বিভেদটা আবীরের রঙে ঢাকা পড়েছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে রয়েছে অসংখ্য স্থাপত্য নিদর্শন ও রীতি নীতির খেলা ঘর। তেমনি এক স্মারকের কথা বলি আজ। শ্রীরামপুরের পাঁচশো বছরের পুরনো এক মন্দির, যেখানে রাধাকৃষ্ণের সাথে সঙ্গে পূজিত হন গৌরাঙ্গ ও বিষ্ণুপ্রিয়া। চাতরা শ্রীরামপুরের শ্রী গৌরাঙ্গ মন্দির। স্থানীয় মানুষের কাছে এটি দোল মন্দির রূপেই পরিচিত, কারণ মন্দিরের প্রধান উৎসব দোলযাত্রা। এটি শ্রীরামপুরের অন্যতম প্রাচীন মন্দির। নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ পূজার চল থাকলেও বাংলার অন্যত্র এমন ধারা অত্যন্ত বিরল। মন্দিরটি স্থাপনের পশ্চাতেও রয়েছে এক কাহিনী যা স্থানীয় বৈষ্ণবদের কাছে বেশ বিখ্যাত।
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের নীলাচলে থাকাকালীন তাঁর অন্যতম সঙ্গী ও ভক্ত ছিলেন পূর্বতন যশাের নিবাসী বাৎস্য গােত্রীয় রাঢ়ী ব্রাহ্মণ কাশীশ্বর পণ্ডিত। কাশীশ্বরের মাতা জাহ্নবীদেবী প্রায় ষোল বছর পুত্রকে না দেখে জ্যেষ্ঠ পুত্র মহাদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে নানা দেশ ঘুরে পুরুষােত্তমধামে কাশীশ্বরের দর্শন পান। মহাপ্রভুর আদেশে মাতার সাথে দেশে ফিরে তিনি কিছুদিন বৈদ্যবাটির নিমাই তীর্থ ঘাটের কাছে বসবাস করেন। পরে গৌড় রাজ সরকারের হুগলী দপ্তর থেকে ১০৮ টাকা বার্ষিক করে চাতরা গ্রামের জমিদারী লাভ করেন। এর কিছুদিনের মধ্যে চৈতন্য মহাপ্রভুর মহা প্রয়াণের খবর আসে। তাঁর স্মৃতিতে কাশীশ্বর পন্ডিত আনুমানিক ১৫৩৪ খৃষ্টাব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে চাতরায় বর্তমান চৌধুরী পাড়ায় এই গৌরাঙ্গ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। আরেকটি প্রবাদ হলো এই যে, পঞ্চদশ শতকে বাসুদেব ভট্টাচার্য্য চাতরার চৌধুরী পাড়ায় একটি শ্রী কৃষ্ণ মন্দির স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র কাশীশ্বর পন্ডিত ওই মন্দিরে শ্রী গৌরাঙ্গ মূর্তি স্থাপন করেন। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু একবার ওই মন্দিরে দোল উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু রাধাকৃষ্ণের পাশে নিজের মূর্তি দেখে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান এবং গৌরাঙ্গ মূর্তিটি ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তার আদেশ মতন ওই মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে কাশীশ্বর পন্ডিতের পৌত্র নতুন গৌরাঙ্গ মূর্তিটি নির্মাণ করে দেন। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং দোল উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন বলেই এই মন্দিরের দোল উৎসব খ্যাতি লাভ করে।
বর্তমানে এই মন্দিরে একই মূল মন্দিরে গৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার অষ্টধাতু নির্মিত মূর্তি এবং কষ্টিপাথরে তৈরি কৃষ্ণ এবং অষ্টধাতুর রাধা মূর্তি পূজিত হয়। সাম্প্রতিক কালে জনৈক সেবাইতের অসাবধানতায় কৃষ্ণ মূর্তিটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আর একটি নতুন কৃষ্ণমূর্তি স্থাপিত হয়েছে। পুরাতন কৃষ্ণমূর্তিটি এখনও মন্দিরে পূজিত হয়। দোলযাত্রাই ছাড়াও রাসপূর্ণিমা, আমবারুণীতে কাশীশ্বর পণ্ডিতের জন্মােৎসব পালিত হয়। মন্দিরের দেবােত্তর ভূমি সরকারে বাজেয়াপ্ত হওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবিদের চাকরান জমি দেওয়া হত। মুসলমান সানাইওয়ালাও এ থেকে বাদ যায়নি।
মন্দিরটি আকারে বিশাল এবং এর তিনটি চূড়া রয়েছে। মন্দিরের নির্মাণ শৈলী অনেকটাই বৈষ্ণব মঠের মতন। মূল মধ্য মন্দিরটি পূজার ঘর, একটি শয়ন ঘর, অন্যটি রন্ধনশালা। এক সময় সেবায়েতদের একাংশের অবহেলায় এবং জমিদারী খাজানা বন্ধ হওয়ায় মন্দিরটির কিছু দৈন্যদশা হয়। পরবর্তীকালে জনসাধারণের চেষ্টায় ও সাহায্যে এটির সংস্কারের ব্যবস্থা সম্ভব হয়। দোল উৎসবে পৃথক দুটি রাস মঞ্চে রাধাকৃষ্ণ এবং গৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার বিগ্রহকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে আবির দান করা হয়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এলাকায় মেলা বসে যায়। প্রচুর ভক্তরা অনেক দূর থেকে এই উৎসব সামিল হতে আসেন।
এই মন্দিরের বিগ্রহের অলঙ্কার কখনও কখনও অপহৃত হয়েছে বলেও শোনা যায়। ১৭৪০ এর দশকে বর্গী আক্রমণে নাকি রাধাকৃষ্ণ ও গৌড়ঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার অসংখ্য গয়না লুন্ঠিত হয়েছিল। এমনকি এই মন্দিরে কালাপাহাড়ের আক্রমণেরও প্রবাদ রয়েছে। বর্তমানে মন্দিরটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘােষিত এবং এই ঘােষণার সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মন্দির সংস্কারের জন্য কিছু অর্থব্যয়ও করেছিলেন। যদিও বর্তমানে আর তেমন সরকারী সহায়তা পাওয়া যায় না। নিকটেই গৌরাঙ্গ সংঘ খেলাধুলো, গ্রন্থাগার স্থাপন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও করেছে এবং প্রয়াত ইন্দুমাধব রায়ের নামে একটি সংঘভবন নির্মাণ করেছে।
প্রাচীন বৈষ্ণব ক্ষেত্র শ্রীরামপুরে বিরাজিত শ্রী গৌরাঙ্গ মন্দির। ছোট্ট গ্রাম থেকে বড় শহরে পরিণত হয়েছে শ্রীরামপুর। তবুও সেই আঙিনায় নিজের জায়গা ঠিকই ধরে রেখেছে এই মন্দির। শহরের আধুনিকতার মাঝেও নিজের রীতি-নীতি সংস্কৃতিকে ভুলে যায়নি। আজও খোল করতালের তালে নেচে ওঠে এই পল্লী। খঞ্জনীর শব্দে মনের মধ্যে জেগে ওঠে পবিত্রতা। ভালোবাসা ও ভক্তিতে নিজে থেকেই মুখে উঠে আসে হরিনাম ডাক। বাংলার সাবেকি বৈষ্ণব সংস্কৃতি এই আধা সহস্র বছর প্রাচীন মন্দিরে আজও বেঁচে।
Discussion about this post