“যে ঠাকুরের ধর্ম নেই, জাতের কোন বর্ম নেই, গীতা-বাইবেল-কোরান নেই, মন্ত্র মানে গান। সেই দেবতার পায়ের কাছে লক্ষ কোটি প্রাণ।” সেই দেবতা আর কেউ নন, বাংলা তথা বিশ্বের সাহিত্য জগতের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুর বাড়ির বংশ ইতিহাস অনুযায়ী, কবিগুরুর পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন ‘কুশারি’ ব্রাহ্মণদের বংশধর। ঐতিহাসিক তথ্য বলে, বাংলার পূর্বাঞ্চল বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে ব্রাহ্মণ শূন্য হয়ে পড়লে কনৌজ থেকে ‘পঞ্চব্রাহ্মণ’ এসেছিলেন এই অঞ্চলে। এই পঞ্চব্রাহ্মণদের একজন ছিলেন ক্ষিতীশ। তাঁর ছেলে ভট্টনারায়ণই ছিলেন প্রকৃত অর্থে ঠাকুর পরিবারের আদি পুরুষ। ভট্টনারায়ণের পাঁচ ছেলের মধ্যে একজন ‘কুশারি’ গ্রামের আধিপত্য লাভ করেন এবং কালক্রমে তাঁর বংশজরা ‘কুশারি’ উপাধিতে পরিচিতি লাভ করেন।
কুশারি বংশের জগন্নাথ কুশারির সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল গোবিন্দলাল রায়ের। গোবিন্দলাল নাকি কোন এক মুসলমানের করা রান্নার ‘ভোজন ঘ্রাণে’ অপরাধী হয়ে পড়েন এবং সমাজ তাঁকে ‘পীরালী মুসলিম’ আখ্যা দেয়। গোবিন্দলালের সাথে যোগাযোগের কারণে জগন্নাথ কুশারিকেও ‘পীরালী ব্রাহ্মণ’ আখ্যায়িত করে সমাজচ্যুত করা হয়। এই পীরালীরা ব্রাহ্মণ হলেও ছিলেন তথাকথিত নিচু শ্রেণী। তাঁদের সাথে সেই সময় কেউই নিজের সন্তানের বিয়ে দিতে চাইতেন না সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে। তবে কন্যাদায়গ্রস্ত শুকদেব রায় চৌধুরী তাঁর কন্যার সঙ্গে জগন্নাথ কুশারির বিয়ে দেন।
প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবি কথা’ থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকে এই কুশারি বংশের পঞ্চানন কুশারি গোবিন্দপুরে বসবাস করতে শুরু করেন। সেই সময় গোবিন্দপুরে বাস করত জেলে, কৈবর্ত্য, মালো প্রভৃতি তথাকথিত ‘নীচু জাত’। এদের মধ্যে পঞ্চানন কুশারি একমাত্র ব্রাহ্মণ পরিবার হওয়ায় ঐ অঞ্চলের লোকজন তাঁকে ‘ঠাকুর’ সম্বোধন করত। এইভাবেই পঞ্চাননের ‘কুশারি’ উপাধি ‘ঠাকুর’ ডাকের আড়ালে অন্তর্হিত হয়ে যায়। কাগজে কলমে এই পরিবার ‘ঠাকুর পরিবার’ নামে পরিচিতি লাভ করে এই সময় থেকেই।
পঞ্চাননের পৌত্র ছিলেন নীলমণি ঠাকুর। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পতনের পর মীরকাশিম ক্ষতিগ্রস্ত নীলমণির পরিবারকে বেশ কিছু অর্থ প্রদান করেন। সেই অর্থের সাহায্যে নীলমণি ও তাঁর ভাই দর্পনারায়ণ উত্তর সুতানুটিতে জমি কিনে বসত বাড়ি তৈরি করেন। বর্তমানে সেই বাড়িই পাথুরিয়াঘাটার ‘ঠাকুর বাড়ি’ হিসাবে পরিচিত। নীলমণির ছেলে রামমণি ঠাকুর এবং পুত্রবধূ মেনকা দেবীর সপ্তম সন্তান জন্মানোর পরেই তাকে দত্তক নিয়ে নেন রামমণিরই বড় ভাই নিঃসন্তান রামলোচন। রামলোচনের দত্তক নেওয়া সেই শিশুপুত্রটি আর কেউ নন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। আর এর পরবর্তী ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস তো সকলেরই জানা।
Discussion about this post