হেতমপুরের রথযাত্রা বীরভূমের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। হেতমপুর রাজবাড়ির পুরনো ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই রথযাত্রা। এই রথযাত্রার বিশেষত্ব হল, এখানে বের হয় ইংল্যান্ড থেকে আনা প্রায় তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো একটি পিতলের রথ। রথটি দেখতে একেবারে সোনার মতোই ঝলমলে। এক সময় ঘোড়া দিয়ে টানা হত এই রথ। কিন্তু সে সব এখন অতীত। তবে ঐতিহ্যবাহী এই রথে এখনও রয়ে গিয়েছে ব্রেক, সকার, স্টিয়ারিং ইত্যাদি।
রাজবাড়ির ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা ১২৫০ সালের আশেপাশে হেতমপুরের রাজা রামরঞ্জন চক্রবর্তী ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট কোম্পানিকে দিয়ে রথটি বানিয়েছিলেন। রথটি তৈরি হয়েছিল রাজপরিবারের গৌরাঙ্গ মন্দিরের গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দের জন্যই। এই মন্দির থেকেই বের হত রাজপরিবারের রথ। রথযাত্রার সময় রাজবাড়ির সামনে বিশাল আকৃতির সুসজ্জিত সাদা ঘোড়া ও তার ঘোড়সওয়ার থাকত। পিছনে থাকত আরও চারটি সুসজ্জিত ঘোড়া। রূপোর দণ্ডের উপর পতাকা লাগিয়ে দুপাশে লাইন করে রথ টানার জন্য থাকত সুবেশ পাইকেরা। এরপরই থাকত নানা ধরনের বাজনার দল। একসময় এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে যাত্রা, নাটক, কবিগান ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। রথের দিন রাজপরিবারের দরজা সকলের জন্য খুলে দেওয়া হত।
এই রথকে ঘিরে একটি কাহিনীও প্রচলিত রয়েছে। বজ্রঘাতে নাকি মৃত্যু যোগ ছিল রামরঞ্জন চক্রবর্তীর। একবার বজ্রাঘাতের হাত থেকে রাজাকে বাঁচাতে নাকি গৌরাঙ্গদেব নিজের আঙুলে বজ্র ধারণ করে নেন। সেই কারণেই বিগ্রহের একটি আঙুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে তৈরি করা হয় নতুন আরেকটি বিগ্রহ। কিন্তু সেই পুরনো গৌরাঙ্গের বিগ্রহটিকে সরানো হয়নি। দুই বিগ্রহ গৌরাঙ্গ ও নিতাইকে নিয়েই রথযাত্রা শুরু হয়।
তবে ২০০৭ সালের পর আর রথকে পথে নামায়নি রাজ পরিবার। কালের নিয়মে রাজত্বের দৈনদশার কারণে রাজপরিবারের সদস্য মাধবী রঞ্জন চক্রবর্তী এই রথ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেন গৌড়ীয় মঠের হাতে। এরপর থেকেই গৌরাঙ্গ মঠ গৌরাঙ্গ মন্দির ও রথ পরিচালনা করে আসছে। তবে যাই হোক না কেন এই ঐতিহ্যবাহী শতাব্দী প্রাচীন রথ দেখভাল করার দায়িত্ব রয়েছে হেতমপুর রাজপরিবারের ওপর।
Discussion about this post