বাঙালির শ্রেষ্ঠতম উৎসব দুর্গোৎসব। দুর্গাপুজোকে ঘিরে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে নানা রীতি নীতি ও ঐতিহাসিক জনশ্রুতি। হুগলী জেলার অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর কামারপুকুর। কামারপুকুর, মা কালি সাধক রামকৃষ্ণদেবের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত। কামারপুকুরের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গা পুজো লাহা বাড়ির পুজো। শোনা যায়, কোনো একবার লাহাবাড়ির মাতৃপ্রতিমার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গেলে, মায়ের চোখ এঁকেছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ দেব।
জানা যায়, লাহা বাড়ির এই পাঠশালাতেই প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলেন রামকৃষ্ণদেব। লাহা বাড়ির পুজো শুরু হয় প্রায় ৪৫০ বছর আগে এই বাড়ির পূর্বপুরুষ জগন্নাথ লাহার হাত ধরে। সঠিক সময় না জানা গেলেও অনুমান করা হয়, ১৮৪৮-১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রামকৃষ্ণ দেব লাহা বাড়ির মায়ের চোখ এঁকেছিলেন। তখন তার পরিচয় ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায় বা গদাই। প্রাচীন প্রথা মেনে এখনও লাহা বাড়িতে মাদুর্গার কাঠামো পুজো হয় বিপত্তারিণী পুজোর দিন। মহালয়ার পরদিন হয় ঘট উত্তোলন। প্রতিপদের দিন থেকেই শুরু হয় মহাচন্ডীর পুজো।
লাহা বাড়ির প্রাচীন এই দুর্গাপুজো ঘিরে রয়েছে এই অলৌকিক লোককথা। জানা যায়, একদিন জমি সংক্রান্ত বিবাদের মামলায় ধর্মদাস লাহা গ্রামের মেঠো পথ ধরে চুঁচুড়া আদালতে যাচ্ছিলেন। কিছু পথ গিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটি গাছের তলায় বিশ্রাম নিতে বসেন। তখন তিনি স্বপ্ন দেখেন তাকে মা দুর্গা বলছেন, ” মামলায় জয়ী হবি তুই। বাড়ি গিয়ে আমার পুজো করিস। খানাকুল থেকে দুজন পটুয়া যাচ্ছে।” কিন্তু মামলার জিতে মায়ের স্বপ্নাদেশ ভুলে যান ধর্মদাস। কিন্তু বাড়ি ফিরতেই চমকে যান তিনি। তিনি দেখেন আগে থেকেই বাড়িতে দুজন প্রতিমা শিল্পী হাজির। তারা জানান, “একটি মেয়ে এসে আমাদের বলল প্রতিমা গড়তে হবে এই ঠিকানায়। তাই প্রতিমা বানাতে এসেছি আমরা।”
তখন থেকেই আবার শুরু হয় প্রাচীন এই দুর্গাপুজো। তখনকার সময়ে পশুবলি প্রথা হলেও ধর্মদাস ছিলেন বৈষ্ণব বাড়ির লোক। তাই তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সাত বেড়িয়ার মোমিনপুরে গুরুদেবের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। পালকি করে যেতে যেতে তিনি দেখা পেলেন এক বৃদ্ধা রমণীর। তিনি ধর্মদাস বাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, “কোথায় যাবে বাবা তুমি?” তখন ধর্মদাস বাবু সব কথা তাকে বললে, তিনি জানান, “মা কি সন্তানের রক্ত চাইতে পারে?” গুরুদেবের কাছে পৌছে পথের সব কথা তাকে বললে, গুরুদেব জানান, “স্বয়ং মা তোমাকে বিধান দিয়ে গেছেন। তাই মেনে চলো।” নবমীর দিন লাহাবাড়িতে হয় কুমারী পুজো। বর্তমানে লাহা বাড়ির সদস্য সংখ্যা প্রায় দু’শো জন। পুজোর দিনগুলিতে তাদের সবার বাড়িতে রান্না বন্ধ। তারা সবাই মন্দিরেই প্রসাদ খান। লাহা বাড়ির মায়ের পুজোর অন্যতম আকর্ষণ হল ৭ দিনের যাত্রাপালা, যা শুরু হয় মহালয়ার দিন ও শেষ হয় ষষ্ঠীর দিনে। লাহা বাড়ির পুজো দেখতে, বহু গ্রামবাসী ভিড় জমান পুজো প্রাঙ্গণে।
Discussion about this post