“আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।” বাস্তব জীবনে কেউ নিজের বনলতা সেনকে খুঁজে পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই তবে ওড়িশার তাঁতি পরিবারের এই ছেলে কিন্তু পেয়েছিলেন। যদিও পেয়েছিলেন বললে নিছকই ভুল বলা হবে, একপ্রকার লড়াই করে পেয়েছিলেন। আমি বলছি ভারতীয় বংশোদ্ভুত সুইডিশ চিত্রশিল্পী প্রদ্যুম্ন কুমার মহানন্দিয়া’র কথা। অবশ্য প্রচারের আলোয় না থাকার ফলে অনেকের কাছেই এই নামটি আজও অপরিচিত। সামনেই ভ্যালেন্টাইনস ডে। বিশ্বজুড়ে ভালোবাসার মরশুম। সহস্র ভালোবাসার গল্প জন্ম নেয়, আবার হারিয়েও যায়। কিন্তু কিছু গল্প চিরকালের জন্য মননে দাগ ফেলে যায়। তেমনই এক ব্যতিক্রমী প্রেমের গল্প প্রদ্যুম্ন কুমারের। প্রেমের প্রতিশ্রুতি রাখতে যিনি দেশের সীমানা অতিক্রম করে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুদূর ইউরোপে। সঙ্গী একটি পুরনো বাইসাইকেল, আজকের ইন্টারনেটের যুগে দাঁড়িয়ে যা অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়।

সালটা ১৯৭৫। দিল্লী আর্ট কলেজে পড়াকালীন ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিকৃতি অঙ্কন করে সরকারী মহলে বেশ প্রশংসিত হন পিকে। এইসময় বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে দিল্লীর কনট প্লেসের বিখ্যাত ফোয়ারা হোলি ফাউন্টেনের পাশে বসে মানুষের প্রতিকৃতি অঙ্কন করতে শুরু করেন। এখানেই তার সাথে প্রথমবার পরিচয় হয় সুইডেন নিবাসী শার্লটের। শার্লট সেইসময় লন্ডনে ছিলেন পড়াশোনা সূত্রে। পিকের শিল্পকর্মে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে নিজের প্রতিকৃতি বানানোর উদ্দেশ্যে প্রায় ২২ দিন সফর করে বিখ্যাত হিপ্পি ট্রেইল ধরে তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান অতিক্রম করে শার্লট ভারতে পৌঁছোন। তখনও তারা জানতেন না এই প্রতিকৃতিই বদলে দেবে তাদের জীবন।

প্রথম সাক্ষাতেই পিকে ও শার্লট একে অপরের প্রেমে পড়ে যান ও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। যদিও এরপরেই শুরু হয় আসল লড়াই। ভিসার মেয়াদ শেষ হতেই শার্লটের দেশে ফেরার সময় হয়ে যায়। যদিও তিনি পিকেকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু পিকে তাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে নিজের উপার্জনের অর্থে একদিন তিনি শার্লটের কাছে ফিরে যাবেন। শার্লট চলে গেলেও চিঠির মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ চলতে থাকে।
দেখতে দেখতে দুবছর কেটে যায়। অবশেষে আসে সেই বিশেষ দিন। ১৯৭৭ সালের ২২ জানুয়ারি বিমানের টিকিট কেনার সামর্থ্য না থাকায় জীবনের যৎসামান্য সঞ্চয়টুকু বিক্রি করে একটি পুরনো বাইসাইকেল কিনে পিকে রওনা দেন ইউরোপের উদ্দেশ্যে। শার্লটের মত একই ট্রেইল ধরে প্রায় চার মাস সাইকেল চালিয়ে অবশেষে ২৮ মে তিনি সুইডেনের বোরাস শহরে পৌঁছান। সুইডেনের এই টেক্সটাইল শহরেই বসবাস করতেন শার্লটের পরিবার। যাত্রাকালে প্রত্যেকদিন গড়ে প্রায় ৭০ কিমি সাইকেল চালাতেন পিকে। প্রেমিকাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও ভ্রমণ পিপাসু মন এই দুইয়ের মেলবন্ধনে বোধ হয় অসম্ভবকে সেদিন সম্ভব করে তুলেছিলেন তিনি। এই প্রসঙ্গে পিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ” সাইকেল চালিয়ে রোজই আমার পায়ে ব্যথা হতো কিন্তু শার্লট কে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এবং নতুন দেশ দেখার উত্তেজনা আমাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।” কিন্তু তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারেন না কেন লোকেরা মনে করেন যে ইউরোপ পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে যাওয়া একটা বড় কোনও ব্যাপার! তাই তো সহজেই এই প্রেমিক হাসতে হাসতে বলেন ” আমার যা করার ছিল আমি তাই করেছি। আমার কাছে কোনও টাকা ছিলো না কিন্তু আমাকে শার্লটের সাথে দেখা করতেই হতো। আমি ভালোবাসার জন্য সাইকেল চালিয়েছি, কিন্তু সাইকেল চালানো ভালোবাসিনি।”
Discussion about this post