বাঙালির গর্বে এবং তর্কে বহুকাল ধরেই বেশ পাকাপাকি ভাবে রাজত্ব করছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জগৎজোড়া খ্যাতি, প্রতিবাদী কর্মকান্ড ছাড়াও আরও যে বিষয়টা বেশ নজরকাড়া তা হল এখানকার ক্যান্টিনের সমাহার। এবার তাহলে এখানকারই এক বিশেষ ক্যান্টিনের ব্যাপারে বলা যাক। নাম তার ‘পোস্ট অফিস ক্যান্টিন’, ঠিকানা কলকাতা ৩২। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদবপুর ক্যাম্পাসের ৩ নং গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে চোখ রাখলেই দেখা মিলবে এই ক্যান্টিনের। দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে বেচারার বয়স হয়েছে ভালোই। আশেপাশে চোখ বোলালেই কয়েকটা গোলে আড্ডা মারতে দেখা যাবে ছাত্র-ছাত্রীদের। ঢুকেই খানিকটা হতাশ হতে হবে বসবার বেঞ্চগুলি দেখে, তবে তা চলনসই বলা যায়। এই ক্যান্টিনের নামকরনের ইতিহাস তো নামেই আন্দাজ করার মতন। যাদবপুর পোস্ট অফিসের গা-লাগোয়া হওয়ায় পরিচিতিও সেটারই ছোঁয়া পেয়েছে। ক্যান্টিনটা যদিও খোলা হয়েছিল মূলত ডাকঘর কর্মীদের জন্যই, পরে সস্তায় পুষ্টিকর খাবারের টানে পড়ুয়ারাও জাঁকিয়ে বসে। এখন তো সবসময়েই তাদের উপস্থিতিতে জমজমাট এখানকার ছাউনি।
এবার আসা যাক আসল কথায়, মানে খাদ্যতালিকায়। কোনো বিশেষ খাবার নয়, বরং এই ক্যান্টিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য হল অত্যন্ত কম দাম। পড়ুয়াদের গড়ের মাঠ পকেটের সঙ্গে সুস্থ সমঝোতা আছে এখানকার মেনুর। ঘুঘনি, চপ, চা-সিঙারা, ম্যাগি, চিনি-মাখন-পাঁউরুটি, কেক, কোলা, স্যুপি-ন্যুডলস, মাংস-ভাত, সোয়াবিনের তরকারি, ডিমের ঝোল, মাছ ইত্যাদি পদ এখানে খুব চলে। সকালে ১১:৩০ টার মধ্যে এই ক্যান্টিন খুলে যায়, দুপুর দিকের সবচেয়ে বেশি ভিড় সামলে রাত ৮ টায় ঝাঁপ ফেলে দেয়।
এখানে গেলে মোটামুটি সব কলেজ থেকে বেড়াতে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যাবে। একে ক্যাম্পাসের অন্যতম নিউট্রাল ক্যান্টিন বলা যায়। মানে কেবল আর্টসের বা কেবল সায়েন্সের ছেলেমেয়েদের বা হবু ইঞ্জিনিয়ারদের দখলে আটকে নেই পোস্ট অফিস ক্যান্টিন। পাশেই বিখ্যাত গ্রিন জো়ন থাকায় অবশ্য কখনই তেমন ফাঁকাও থাকে না এই চত্বর। মজার বিষয় হল, অন্যান্য ঝকঝকে ক্যান্টিনগুলির তুলনায় অবহেলিত হলেও, সাধারণত এই ছাপোষা ক্যান্টিনের দৈনন্দিন আড্ডাগুলোর থেকেই বেশিরভাগ স্বাধীন অনুষ্ঠান বা কর্মসূচির খসড়ার সূচনা হয়। শোনা যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় নাকি এখানেরই এক কর্মচারীকে দেখে ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ কবিতাটি লিখেছিলেন। এবার সেকথা খাঁটি সত্যি কিনা জানা নেই, তবে শুনতে বেশ লাগে।
শেষে আসি আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথায়। কখনো বন্ধুদের মতন পকেটে নিত্য টান পড়ার দরুন, কখনো গান শুনে মুগ্ধ হয়ে কোনো দাদার সাথে আলাপ করার হুজুগে বা অন্য ডিপার্টমেন্টের প্রিয় দিদির ডাকে পোস্টার লেখার নেশায় বারবার হাজির হয়েছি এই ক্যান্টিনে। সবসময় আসলেই মনে হয় এখানে এসে যেন আমাদের ক্যাম্পাসটা হঠাৎ বাইরের বড় জগৎটার সঙ্গে মিশে গেছে। আমরাও যেন সেই ব্যাপারটার সাথে তাল মিলিয়ে রোজ এখান থেকে বেরিয়ে একটু একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছি। সেই ফাঁকে ক্যান্টিনটাই কখন অধমের ঠিকানায় নিজেকে নিয়ে এমন চিঠি ফেলেছে কে জানে!
প্রতিবেদনে অনুষ্কা সাহা
চিত্র ঋণ – বিদু, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post