আমি পথ চলি আর আজন্ম করুণ বেদনায় চেয়ে থাকি ন্যুব্জপিঠ সেই মানুষগুলোর দিকে যারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে মাছের বাজারে, ইলিশের ঝাঁকিতে। পান্তা ইলিশ না খেলে বুঝি পহেলা বৈশাখ পালনই হলো না। এই আমাদের ক্ষণিকের বাঙালিয়ানা। মুখোশের আড়ালে স্বজাত্যবোধ আর নিজস্ব সংস্কৃতির চেতনা লজ্জিত চোখে তাকায়। আমার মনে একটি প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে। বাঙালি কবে আর চিনবে নিজেরে? যে কোনো বিষয়কে একটি দিন, একটি বিশেষ উপলক্ষ্য মনে করিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট । কিন্তু একদিন পান্তা ইলিশ খেয়ে লাল-শাদা শাড়ি-পাঞ্জাবী পরে পরদিনই মোরগ মোসল্লামে ঢেকুর তুলি, জিন্স ফতুয়া গায়ে দিয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ি। অনর্গল বাংলিশ ভাষায় কথা বলি। নিজের আভিজাত্য প্রকাশ করি সগৌরবে। এই কি বাংলা নববর্ষ পালনের আসল উদ্দেশ্য!
বছরের প্রথম দিনে উন্মত্ত মানুষের ঢল। অন্যদিকে একদল ধর্মান্ধের ধারালো চাপাতিকে আরও ধার চকচকে করা। কে যে কারে (নিজেরে) আদৌ চিনতে পায়। তারা কি জানে একদিন বাংলার গৌরব ছিল ধানের, গৌরব ছিল পাটের, গৌরব ছিল কৃষাণীর টিয়াপাখি নাকে ফসল বিক্রির টাকায় কেনা নাকছাবিতে। ধর্ম ভুলে উঁচু নীচু জাত ভুলে হিন্দু-মুসলিম একত্রে বৈশাখের প্রথম দিন পালন করবার আরও গৌরব ছিল। জানেনা অন্ধ আর সুশিক্ষিত এই ধর্ম ব্যবসা, জানেনা উন্মত্ত প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন মানুষও। একটু পেছনে যদি তাকাই, বাংলার কৃষিনির্ভর মানুষের মনে এক ধরনের সহজাত বিশ্বাস আর সংস্কার থেকে তারা জীবনের তাগিদেই একসময় পালন করতো বাংলা বছর শুরুর প্রথম দিনটিকে। বাংলার কৃষিজীবী মানুষের সংস্কারের মূলে ছিল প্রাকৃতিক আর অতীন্দ্রিয় শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা। তাদের কাছে বছরের প্রথম দিনটি ছিল সারা বছরের শুভাশুভ নির্ণায়ক। কৃষি নির্ভর বাংলার কৃষির জন্য তখন নির্ভর করতে হতো একমাত্র বৃষ্টির উপর। তাই তারা অপেক্ষা করে থাকতো বছরের প্রথম দিনটিতে বৃষ্টির জন্য। প্রার্থনার যে ধরণ কিংবা লোকাচার তা ছিল হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষেই, অসাম্প্রদায়িক।
সারা বছর ব্যাপী যারা ফসলের উপর নির্ভরশীল। তারা যে ধর্মেরই হোক তাদের জীবিকার ক্ষেত্র ছিল অভিন্ন। তাই একই ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশে একই স্বার্থে একত্রিত হতে তাদের কোনো সংস্কার জনিত বাধা ছিল না। পৌষ পার্বণে মাগনের গানগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যাদের উপলক্ষ্য করে মাগন করা হত তাদের মধ্যে হরি-আল্লা- সোনা রায়- সোনা পীর-মানিক পীর-গাজি পীরের নামে মাগন করা হতো। বালকেরা বাড়ি বাড়ি গান করে মাগন করতো যেখানে সোনা রায় আর সোনা পীর হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে মিলেমিলে একাকার হয়ে যেত। আবার লক্ষ্মী দেবীও মুসলমান কৃষক দ্বারা পূজিত হয়ে এসেছেন দীর্ঘদিন। কারণ পেশার সঙ্গে লক্ষ্মীর সম্পর্কটা ছিল বরাবরই ভীষণ নিকট। দেবী লক্ষীর কৃপাদৃষ্টি পেলে ব্যবসা আর ফসলের উন্নতি হবে বছর ভর, এ ছিল আজন্ম কিষাণ কিষাণীর বিশ্বা।স সে হোক মুসলিম কিংবা হিন্দু। এমনও দেখা গিয়েছে সন্তানকে সাপে কাটলে মুসলিম কৃষাণী দেবী মনসার পূজোও করেছেন নির্দ্বিধায়। আসলে ধর্ম একটি পার্সোনাল ল। এর দারুণ প্রযোগ করে গেছেন না জেনে না বুঝেও অশিক্ষিত সাধক যাকে কবি একদিন দধীচির চেয়েও বড় সাধক বলে উল্লেখ করে গেছেন। তখন কি ছিলনা এই বাঙালির? ফসল ভরা মাঠ। গোলাভরা ধান। সোনালী আঁশ বিদেশে বিক্রী করে আনা প্রচুর বিদেশী মুদ্রা। পুকুর ভরা মাছ। ইলিশের অভয়ারণ্য কি ছিল না একদিন বাংলার নদী? যে দেশে বাস করছি। যে ভূখন্ডের মাটি আমার খাবার জোগায় যে নদীর মাছ আমার শরীরে পুষ্টি জোগায় যে চরাচরে আজন্ম লালিত হচ্ছি তাই তো নির্ণয় করে দিয়েছে আমার খাবার, আমার ভাষা, আমার আনন্দ, আমার আভিজাত্য, আমার সুখ দুঃখ সব। এই ভূগোলে আমার মা যেমন পড়েছে লাল শাড়ি আমার প্রিয় হিন্দু সখীর মাও একই শাড়ি পড়েছে। তবে কী প্রভেদ আমার আর হিন্দুর সংস্কৃতিতে? এই তো চিরায়ত বাংলার সংস্কৃতি। বহুকাল ধরে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করা মানুষ প্রকৃতির পরিবেশের সাথে মানিয়ে যে পোশাক, যে আচার পালন করে আসে তাই তো তার সংস্কৃতি। এর সঙ্গে ধর্মের কোনই সংঘর্ষ তো নেই। এখানে নতুন বৌ-কী হিন্দু কী মুসলিম কী খ্রীস্টান সকলেই পায়ে পায়ে আলতায় রাঙিয়ে পরেছে সোনার মল, কপালে দিয়েছে সিঁদুর অথবা টিপ আর সবুজ ঘাসের বুকে হৃদয়ের শুদ্ধতা বয়ে গিয়েছে কৃষাণের গায়ে দাবদাহে কোমল শান্ত বাতাস হয়ে। এখানে খোদা, ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ এক হয়ে মিশে গেছেন বাংলার প্রাণে ফসলের মাঠে। গরীব চাষী কি শুধু পান্তায় সারেনি সকালের খাবার?
আজ যখন ধর্মাধর্মের ক্ষুরধার পথ আগলে দাঁড়ায় মানুষের ভালোবাসা চিরায়ত লালিত জাতিবোধ আর আন্তরিক অঙ্গসজ্জা তখন ভুলতে বসি, কোনটি আমার সংস্কৃতি কোনটি আমার আচার-নিষ্ঠা। কৃষকের কিংবা শ্রমজীবী মানুষের যে শিশুটি আজ ইলিশের অভাবে শুধুই লবণ দিয়ে খেয়ে নেয় পান্তা আর উদযাপন করে নতুন বছরের প্রথম প্রহর। উদোম গায়ে অভুক্ত শরীরে যখন নীড়হারা শিশু পথে দাঁড়িয়ে থাকে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে তখন আমি ইলিশের বাজারে হাজার টাকাওয়ালা মাছিদের ওড়াওড়ি দেখে লজ্জিত হয়ে মুখ ঢাকি। আর বুঝতে পারিনা মা, ইলিশ খাওয়াই কি নববর্ষ উদযাপন এই প্রশ্নের কী দেব উত্তর!
এই লেখাটি যখন লিখতে বসি তখন সব রাগ ক্ষোভ দূঃখ অভিমান মনোভার গিয়ে পড়ে নিজের জাতিগত পাপেরও ওপর। জাতিগত অবজ্ঞা আর কর্মযজ্ঞের ওপর। কিন্তু আজ এই মহূর্তে পৃথিবী বিপুল অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই সময় প্রাণে প্রাণ মিলে প্রাণ সংহারককে অবদমন করাই পৃথিবী ব্যাপী মানব জাতির পরমব্রত। তাই আজ পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে নেই কোনো অনুষ্ঠান, নেই কোনো আনন্দ উদযাপন। ঘরে ঘরে মানুষ কাঁদছে। কেউ মা-বাবা হারিয়েছে। কেউ সন্তান আত্মীয় পরিজন হারিয়েছে। কেউ সৎকার করতে পারছে না মৃত আত্মীয়ের শব। কেউ শঙ্কায় জীবন কাটাচ্ছে। এই বুঝি কোনো অসতর্ক মুহূর্তে করোনা আক্রমণ করে বসে শরীরে। এমন সময়টায় বসে জাতিগত প্রথা পালন, লালন কিংবা উদযাপনে কোনো ঝোঁক নেই। নেই কোনো আনন্দ। বিশেষতঃ আমার কাছে তা অর্থহীন। তাই আসুন, এই মহূর্তে নিজের অস্তিত্বের সংকটকালকে কাটিয়ে ওঠার শপথটাই বড় করে নিই সমগ্র বাঙালি জাতি এবং বিশ্বমানব জাতি। নতুন বছর পুরোনো সব আবর্জনা দূর করুক এ তো বরাবরই আমরা গেয়ে আসছি, কবি লিখে আসছেন। আজ নতুন বছরে কালবৈশাখীর ঝড়ে, তপ্ত বাতাসে, রুদ্র প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক করোনার আক্রমণ। পরিশুদ্ধ হয়ে উঠুক মানবাত্মা। পরিশুদ্ধ হয়ে উঠুক সাম্রাজ্যবাদী আত্মম্ভরিতা। ঘরে ঘরে দেশে দেশে নিরাপদ হয়ে উঠুক সকলের আবাস আর কর্মস্থল। কোলাহলে মুখর হয়ে উঠুক স্বদেশ। স্বকর্মে আর মানুষের স্বধর্মে আবার নিয়োজিত হোক আন্তর্জাতিক মানুষ।
Discussion about this post