স্কুলের বাইরে দরদর করে ঘামছেন মা বাবারা, বাচ্চারা বেরিয়ে এলেই বাড়িমুখো হবেন।গরমের ছুটির আগে স্কুলের শেষ দিন। যাঁরা সাইকেল নিয়ে এসেছেন তাঁদের পা প্যাডেলে, বাইক আরোহীরাও তৈরি, আবার কেউ কেউ এই ফাঁকে রিক্সার খোঁজ করে নিচ্ছেন। অনেকেরই হাতে দেখা যেত ছোটো একখান ডাব অথবা গ্লুকোজ গোলা জলের বোতল। অথচ এরা প্রত্যেকেই জানেন বাড়ি ফেরা খুব সহজ হবে না। কিছু বাজে পয়সা খসবে এবং বাচ্চাদের কিছু বেয়াড়া বায়নাকে পাত্তা না দিয়ে উপায় থাকবে না। বড়রা গরমে যতই কষ্ট পান ছোটদের কাছে গরমকাল মানেই ইস্কুলের লম্বা ছুটি আর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা রঙিন খাদ্যের সম্ভার। স্কুলের বাইরে, খেলার মাঠে, অলিতে গলিতে ঠিক সময় ঠিক জিনিসটা সাদা থার্মোকলের বাক্স থেকে উঁকি মারে। সেটি হল ‘পেপসি’। না না, এ তোমাদের বোতলের কালো ঠাণ্ডা মিষ্টি জল নয়।
তখনও ইন্টারনেট আসেনি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে কোনো মোবাইল ফোন নয় বরং হরেক রকম রঙিন জিনিস দেখা যেত। এমনই একটা জিনিস ছিল ‘পেপসি’— প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া মিষ্টি রঙিন বরফ। এককথায় ঠান্ডা লজেন্স (শুধু একটু লম্বা)। এটার নাম যে কীভাবে পেপসি হল তা অবশ্য জানা যায় না। খুব সম্ভবত পপসিকল্ নামটা সহজে উচ্চারণের লোভ এবং বাজার চলতি একটা সফট ড্রিংকের নাম কাছাকাছি এসে যাওয়াতেই ওটার নামকরণ হয়েছে পেপসি। আজ থেকে বছর পনেরো আগেও এর দাম ছিল পঞ্চাশ পয়সা থেকে এক টাকার মধ্যে। দামের এই ব্যবধানের কারণ ছিল স্বাদের বৈষম্য। ছোটোদের রঙিন খাবার বলে কী যা-তা নাকি। অরেঞ্জ ফ্লেভার হলে পঞ্চাশ পয়সা আর কুলফি বা চকোলেট হলে এক টাকা, পরে দু টাকা। স্কুলের বাইরে, মেলার মাঠে খুদে চোখ খুঁজত পেপসিওলাকে। অথবা গরমের দুপুরে পেপসিওলার “এ পেপসি লে লে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পেপসিইই” হাঁকটা শোনার জন্য ছোটো ছোটো কানগুলো ওঁত পেতে থাকত। আর একবার সেই মধুর ডাক কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে মানেই সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় বেগে নামার শব্দ।
অথচ পেপসি তো বাড়ির বড়রা দিতেই চায় না। শুধু পেট খারাপের ভয় দেখায়। বলে, ওগুলো নাকি খারাপ জল থেকে তৈরি হয়। অমন সুন্দর রঙিন পেপসি খেয়ে এক প্যালারাম ছাড়া আর কারুর শরীর খারাপ হতে পারে না। মজার কথা হল জিনিসটার দাম এত কম যে বড়োরা সবসময় কিনে না দিলেও ছোটদের থলি থেকে ঠিক একটি টাকা বেরিয়েই পড়ত। আজকাল স্কুলের বাইরে, চাঁদি ফাটা দুপুরে এ জিনিস আর দেখবেন না। ছোট ছেলেমেয়েদের চাহিদাও বদলেছে। ওরা সত্যিকারের পেপসি চিনেছে। প্লাস্টিকে মোড়ানো রঙিন বরফগুলো যেন ছিল খেলনা পেপসি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সেই পেপসি এখনও ঝাড়ে বংশে উচ্ছন্নে যায়নি। এই পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রীর গরমে হাওড়া বা উত্তর কলকাতার নিরিবিলি গলির মধ্যে ঘুপচি দোকানের সামনে যদি দেখেন একটা রঙিন প্লাস্টিক সুতো দিয়ে ঝোলানো, তাহলে একবার খোঁজ করে দেখতে পারেন। অবিশ্যি দামটা এখন এক টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকায়।
Discussion about this post