বাঙালি মানেই শিল্পকলা। বহু প্রাচীন স্থাপত্য থেকে শুরু করে খাদ্যতালিকাতেও চোখে পড়ে বাঙালির শিল্পচেতনার নমুনা। রকমারি স্বাদ ও গঠনের বহু মিষ্টি তৈরি বাঙালিরই অনবদ্য কীর্তি। তাদের মধ্যে অন্যতম ও ব্যতিক্রমী পাতক্ষীর। পাতক্ষীর হলো বাংলাদেশের তথা সিরাজদিখানের একটি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত মিষ্টান্ন। এই ক্ষীর তৈরি করার পর পাতায় মুড়িয়ে পরিবেশন করা হয় বলে এর নামকরণ করা হয় পাতাক্ষীর, যা বর্তমানে পাতক্ষীর নামেই পরিচিত।
সিরাজদিখান হল বাংলাদেশের অন্তর্গত মুন্সীহঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। এই ভিন্ন স্বাদের মিষ্টান্নর উৎপত্তি এখানেই। কলাপাতায় মোড়ানো এই মিষ্টান্ন ক্ষীরের একটি বিশেষ সংস্করণ। জানা যায়, মুঘল আমলে থেকেই ঢাকাবাসীর খাদ্যতালিকায় পাতক্ষীরের অবস্থান ছিল। সিরাজদিখান উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রামের প্রবীণদের মতে, এই মিষ্টান্নর বয়স প্রায় সোয়া দুশো বছর। সর্বপ্রথম পুলিনবিহারী দেব তার স্ত্রীকে নিয়ে পাতক্ষীর তৈরি করেন নিজ বাড়িতে। এখন তাদের বংশধররাই বানাচ্ছেন এই মিষ্টান্ন। মা ক্ষীর ভাণ্ডার এর মালিক ভরত ঘোষ জানান, “আমি আমার এবং আমার ভাইয়ের সন্তানদের দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছি, যে তারা যতই উচ্চশিক্ষিত হোক না কেন, আমাদের পরিবারের শত বছরের ঐতিহ্য এই পাতক্ষীর তৈরী থেকে যেন বিরত না হয়।”
পাতক্ষীর তৈরির উপকরণগুলি হল দুধ, চিনি, হলুদ গুঁড়ো আর কলাপাতা। প্রথমে দুধকে জ্বাল দিয়ে ঘন এবং অল্প পরিমাণ করতে হয়। দুধ জ্বাল দেওয়ার সময় কাঠের চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে তা নাড়তে হয় যাতে পাত্রের তলায় দুধ লেগে না যায়। এরপর দুধ ঘন হয়ে এলে তাতে সামান্য হলুদ ও পরিমিত পরিমাণ চিনি মিশিয়ে উনান থেকে নামাতে হয়। সবশেষে ক্ষীর তৈরি হওয়ার পর তা মাটির হাঁড়িতে রেখে ঠাণ্ডা করতে হয়। পাতক্ষীর মিষ্টান্ন তৈরির সাথে মিশে আছে এক অদ্ভুত প্রাচীন রীতি। পরিবারের মেয়েরা এই পাতক্ষীর রান্নার বিদ্যা শেখেনা। বরং যারা বৌ হয়ে বাড়িতে যারা আসেন তাদেরই এ কাজ শেখার রীতি রয়েছে। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের মতে, মেয়েরা বিয়ের পর চলে যায় অন্য পরিবারে। ফলে তাদের হাত ধরে এই বিদ্যা অন্য পরিবারে চলে যেতে পারে। তাই পরিবারের মেয়েদের এই বিদ্যা শেখানো হয় না।
সারাবছর চাহিদা থাকলেও শীতকালে এর চাহিদা বেড়ে যায়। একটি পাতক্ষীর বানাতে তিন লিটার মত দুধ লাগে। প্রতিটি পাতক্ষীরের ওজন প্রায় আধ কেজি ও দাম হয় ২৫০ টাকা। বাজারে দুধের দাম বেড়ে গেলে বেড়ে যায় পাতক্ষীরের দামও। সিরাজদিখানের আশেপাশের অঞ্চলগুলির পাশাপাশি ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স ও জাপান থেকেও পাতক্ষীরের অর্ডার আসে নিয়মিত। বাঙালি ঐতিহ্যের পাটিসাপটার সাথেও জড়িয়ে রয়েছে পাতক্ষীরের কথা। পাটিসাপটা তৈরিতেও ব্যাবহার হয় পারক্ষীর। এই অঞ্চলের গ্রামগুলিতে মুড়ির সঙ্গেও পাতক্ষীর খাওয়ার পুরনো রীতি প্রচলিত রয়েছে।
তথ্য ঋণ – উজ্জ্বল দত্ত
Discussion about this post